শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৮ অপরাহ্ন
২০০৮ সালের ১ আগস্ট তরিকত ফেডারেশনের দায়ের করা এক রিট মামলার রায়ে হাইকোর্ট ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। চলতি বছরের ২৯ অক্টোবর রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলর প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নিবন্ধন বাতিল হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এ দলের ২২ নেতা এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের জোটসঙ্গী বিএনপির মনোনয়নে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন। স্বতন্ত্র হিসেবেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন জামায়াতে ইসলামীর ৩ জন নেতা।
নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতের ২৫ নেতার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে চার ব্যক্তির করা একটি রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৮ ডিসেম্বর রুলসহ আদেশ দেন। জামায়াত নেতাদের প্রার্থিতা বাতিলের পদক্ষেপ নিতে ওই চার রিটকারী নির্বাচন কমিশনে যে আবেদন করেছিলেন, তা তিন দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলা হয় আদেশে। উচ্চ আদালতের সেই আদেশের চিঠি ২০ ডিসেম্বর ইসিতে পৌঁছায়। ওই দিনই ইসি সচিব জানান, আইন শাখায় বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ইসিতে বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে। এরপর ইসি তিন দিনের সময়সীমা মেনে সোমবারের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, রিটকারীরা তাদের করা রিট আবেদনে বলেছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নেই, তাই ওই দলের কোনো নেতা নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে পারছেন না। যেহেতু নিজস্ব প্রতীকে পারছেন না, সেহেতু অন্য কোনো দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও সুযোগ তাদের নেই। তাদের সেই সুযোগ দিয়ে নির্বাচন কমিশন হাইকোর্টের রায় ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের বিভিন্ন বিধির সঙ্গে ‘প্রতারণা, প্রবঞ্চনা’ করেছে।
ইতোপূর্বে, গত ২৩ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বলেছেন, জামায়াতের সদস্যদের স্বতন্ত্র বা জোটগতভাবে নির্বাচন করা থেকে বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় আইন নেই। বিদ্যমান আইনে কী করা সম্ভব তা কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে বসে পর্যালোচনা করা হবে। অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নেতারা নিবন্ধিত দলের সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচন করতে পারবেন কি-না সাংবাদিকরা জানতে চাইলে গত ৯ নভেম্বর ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, এটি আইনে কোথাও নেই। কিন্তু কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল যদি অনিবন্ধিত দলের প্রার্থীকে নমিনেশন দেয়, তাহলেতো আমরা বাধা দিতে পারবো না। এ বিষয়ে আইনে কোনো ব্যাখ্যাও নেই।
একই ধারাবাহিকতায় গতকাল ২৩ ডিসেম্বর রাত প্রায় সাড়ে ৮টায় ইসির প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ২৫ নেতার প্রার্থিতা বহাল রেখেছে ইসি। এই প্রার্থিতা বাতিলের সুযোগ ইসির হাতে নেই বলেই তাদের প্রার্থিতা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসি সচিব বলেন, কমিশন সভায় জামায়াতের ২৫ প্রার্থীর প্রার্থিতা বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আদেশ বিশ্লেষণ করে কমিশন দেখেছে, বিদ্যমান আইনে এসব প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে এই ২৫ জামায়াত নেতার প্রার্থিতা বহাল থাকছে।
তাহলে বোঝা গেল, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে নির্বাচন করা থেকে বিরত রাখার আইন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইসি হাইকোর্টের আদেশ চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। ইসির বিজ্ঞতা ও প্রাজ্ঞতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ইসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে একটা ‘কিন্তু’ থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২(১) অনুযায়ী, ‘আইন’ অর্থ ‘কোন আইন,
অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল
এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতি।’ আইনের
সাংবিধানিক সংজ্ঞা থেকে আমরা তাহলে দেখতে পাচ্ছি ‘আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে
কোন প্রথা বা রীতি’ও আইন হিসেবে গণ্য। বিশ্বজুড়ে একটি অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত
Legal Maxim (লিগ্যাল ম্যাক্সিম) বা আইনী রীতি হচ্ছে: ‘What cannot be
done directly cannot be done indirectly’ অর্থাৎ ‘কোন কাজ যদি সরাসরি না
করা যায়, তবে সেই কাজ পরোক্ষভাবেও করা যাবে না’।
এই লিগ্যাল ম্যাক্সিম যাত্রা শুরু করেছে সেই ১৮৮১ সালে কানাডাতে। তবে তা
সুপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮২ সালের যুক্তরাজ্যের Privy Council-এর Charles Russell
বনাম The Queen এবং Queen’s Bench Division-এর Todd বনাম Robinson মামলা
দু’টির রায়ের মাধ্যমে। লিগ্যাল ম্যাক্সিমটি যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়
Hammer বনাম Dagenhart মামলাটির মাধ্যমে। অস্ট্রেলিয়াতে প্রথমবারের মত এই
লিগ্যাল ম্যাক্সিমটিকে গ্রহণ করা হয় ১৯০৪ সালের অস্ট্রেলিয়া হাইকোর্টের
Sydney Municipal Council বনাম Commonwealth এবং D’Emden বনাম Pedder মামলা
দু’টিতে। তবে লিগ্যাল ম্যাক্সিমটি অস্ট্রেলিয়াতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়
অস্ট্রেলিয়া হাইকোর্টের ১৯০৮ সালের R বনাম Barger এবং ১৯১১ সালের Osborne
বনাম Commonwealth মামলা দু’টির রায়ের মাধ্যমে। আলোচ্য লিগ্যাল ম্যাক্সিমটি
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বহু মামলাতেও প্রয়োগ করা হয়েছে। ঊদাহরণ হিসেবে
তুলে ধরা যায়, ১৯৭৯ সালের Jagir Singh বনাম Ranbir Singh, ২০০০ সালের M C
Mehta বনাম Kamal Nath, ২০১০ সালের Sant Lal Gupta বনাম Cooperative Group
Housing Society Ltd ইত্যাদি মামলা।
এখন তাহলে আইনি ব্যাপারটা আমরা একটু মিলিয়ে নেই। হাইকোর্ট ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত না হওয়ার কারণে জামায়াতে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না। দলতো আর প্রার্থী হয় না, হয় দলের সদস্যরা। তাই যদি হয়ে থাকে, তবে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী অনিবন্ধিত হওয়ার কারণে জামায়াতের কোনো সদস্য নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না। এটাই তাহলে আদালত কর্তৃক ঘোষিত আইন যাকে আমরা Judge-made Law বলি এবং আমাদের সংবিধান অনুযায়ী তা খুবই আইনসিদ্ধ।
এবার আসি, বিশ্বজুড়ে সুপ্রতিষ্ঠিত লিগ্যাল ম্যাক্সিম বা আইনি রীতি ‘What cannot be done directly cannot be done indirectly’ বিষয়ে। আগেই বলেছি এই সুপ্রতিষ্ঠিত লিগ্যাল ম্যাক্সিম বা আইনি রীতির অর্থ হচ্ছে ‘কোন কাজ যদি সরাসরি না করা যায়, তবে সেই কাজ পরোক্ষভাবেও করা যাবে না’। তাহলে, হাইকোর্ট-এর রায় অনুযায়ী জামায়াতের কোন সদস্য যদি নির্বাচনে directly (সরাসরি) অংশগ্রহণ করতে না পারে, তবে সে কী করে অন্য দলের আড়ালে লুকিয়ে নির্বাচনে indirectly (পরোক্ষভাবে) অংশগ্রহণ করতে পারে? সেটা কি সুপ্রতিষ্ঠিত লিগ্যাল ম্যাক্সিম বা আইনি রীতিকে লঙ্ঘন করা হলো না? বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২(১) অনুযায়ী, আইনের সাংবিধানিক সংজ্ঞাতে যেহেতু ‘আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোনো প্রথা বা রীতি’কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাহলে বিএনপি দলটির আড়ালে লুকিয়ে বা স্বতন্ত্রভাবে জামায়াতের ২৫ সদস্য কিছুতেই নির্বাচনে indirectly অংশগ্রহণ করতে পারে না। আর যদি তারা সেই কাজ করে, তবে তারা নিজেরা এবং তাদের সহযোগিতা করার জন্য বিএনপি দু’দলই আইন ভঙ্গের দোষে দুষ্ট যা নিঃসন্দেহে আদালত অবমাননার শামিল। জানি না, জামায়াতের প্রার্থিতা বিষয়ে আমাদের ইসি যখন সংশ্লিষ্ট আইন খুঁজে ব্যর্থ হয়েছেন, বিশ্বজুড়ে সুপ্রতিষ্ঠিত লিগ্যাল ম্যাক্সিম বা আইনি রীতি-নীতিগুলোতেও চোখ বুলিয়েছেন কি-না!