সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০৪ অপরাহ্ন
নির্বাচনী ইশতেহার হচ্ছে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্র পরিচালনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, নিজ দলের আদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থান ঘোষণা এবং ভোটারদের তথা জনগণের প্রতি তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। বাংলাদেশে সাধারণত প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলো প্রথাগতভাবে তাদের নিজস্ব নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে থাকে। এই নির্বাচনী ইশতেহারের অন্তর্ভুক্ত বিষয়বস্তু দেখেই সাধারণ জনগণ কোন দলকে ভোট দেবে তা নির্ধারণ করে থাকে। অতএব, সেদিক থেকে দেখতে গেলে একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে আমরা আমাদের দেশ ‘বাংলাদেশ’কে অর্জন করেছি। বিশ্বের মানচিত্রে আপন স্বকীয়তায় স্থান করে নিয়েছি। যুদ্ধ কখনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। যুদ্ধের নির্মমতা ও হিংস্রতা কখনো একটি নির্যাতিত জাতির স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। যে ব্যক্তি বা জাতি যুদ্ধে তার বা তাদের নিরপরাধ আপনজন হারিয়েছে, অকারণে অত্যাচারিত হয়েছে, সে বা তারা কী করে সবকিছু ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে? গণহত্যা ও যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার তাই একটি নির্যাতিত জাতির জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের অন্যতম দাবি রূপে দেশে-বিদেশে স্বীকৃত হয়ে আসছে।
জাতীয় প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ’ জারি করা হয়। দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন আদালতে তাদের বিচার শুরু করা হয়। এরপর পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’ পাস করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা পুনর্বাসিত হয়। এমনকি, ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করা হলে ওই আইনের অধীনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমও বাংলার মাটিতে বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে কোটি বাঙালি প্রত্যাশায় থাকে অসম্পূর্ণ যুদ্ধাপরাধ বিচারের পুনর্জাগরণের জন্য। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘গণ আদালত’ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নতুনভাবে বিকশিত করে। সেদিনের সেই আন্দোলনে শরিক হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াদা করেন- ক্ষমতায় গেলে সুযোগ পাওয়া মাত্রই তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করবেন। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের বিচার করবেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা কথা রেখেছেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দিনবদলের সনদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহার-২০০৮’ ঘোষণা করা হয়। সেই ২০০৮ সালের ইশতেহারের ধারা ৫ ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে। মানে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ইশতেহার-২০০৮-এর ৫ ধারা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করলে দেশে ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ করবে বলে জনগণের কাছে অঙ্গীকার করে। সেই ৫ ধারার ৫.১ অনুধারাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করবে। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে ‘দিনবদলে’র নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিলো, মনে করা হয় সে সময় ভোটার টানতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলো সেই ইশতেহার।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ইশতেহার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা। সে নির্বাচনে তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিজয়ী হয়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তাব পেশ করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অবশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।
এখন পর্যন্ত এই ৮ বছর ৮ মাসে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে মোট ৩৫টি যুদ্ধাপরাধ মামলার নিষ্পত্তি করেছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিশ্বের যে কোনো দেশের জন্য এ এক অনন্য উদাহরণ। এর শুধু রায় নয়, আপিল পেরিয়ে মোট সাতটি যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করেছে বাংলাদেশ। এই সাতটি রায়ের মধ্যে ছয়টিতে জামায়াতের দুই সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় রিভিউতে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন।
প্রথমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর তার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়। দ্বিতীয় অপরাধী হিসেবে ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাত ১০টা ১ মিনিটে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ মৃত্যুদণ্ড একসঙ্গে কার্যকর করা হয়। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ২০১৬ সালের ১১ মে রাত ১২টা ১০ মিনিটে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ষষ্ঠ মৃত্যুদণ্ড হিসেবে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কাশিমপুর কারাগারে রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে।
এছাড়া সাঈদীর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর কারাগারে মারা গেছেন ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম। বিএনপির সাবেক নেতা আবদুল আলীমও আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করা অবস্থায় ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট মারা যান।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দিনবদলের সনদ-এর প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহার-২০০৮’ ঘোষণা করা হয়েছিল, তার বরখেলাপ আওয়ামী লীগ করেনি। কেউ কথা না রাখলেও, আওয়ামী লীগ কথা রেখেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার এই বাংলার মাটিতে করেই ছেড়েছে। জয়তু আওয়ামী লীগ!