রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৪০ পূর্বাহ্ন
দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলার ভরসাস্থল বরিশালের শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়েছেন। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই উন্মুক্ত স্থানে ফেলায় স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়ছে। ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবে কোনো মিল নেই। মান্ধাতার আমলের বিকল ইনসেনেটর নিয়েও বিপাকে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
শেবাচিম হাসপাতাল সূত্র জানায়, এখানে কাগজে-কলমে এক হাজার বেড থাকলেও বাস্তবে ইনডোর-আউটডোর মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ চিকিৎসা নেন। এর সঙ্গে নতুন ১৫০টি করোনা বেড যুক্ত হয়েছে। এ বিপুলসংখ্যক মানুষের চিকিৎসায় প্রতিদিন কয়েক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কিন্তু এসব বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনার কোনো সঠিক পদ্ধতি হাসপাতালে নেই। শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন বলেন, করোনা ওয়ার্ডের বর্জ্য তাৎক্ষণিকভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এছাড়া হাসপাতালের পেছনে গর্ত করে অন্যসব ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ফেলা হয়। পরিচালকের দাবি, প্রতিদিন বর্জ্য ফেলার পর সেখানে ব্লিচিং পাউডার এবং সোডা দেয়া হয়। কিন্তু সরেজমিন গর্তে বর্জ্য দেখা গেলেও ব্লিচিং পাউডার কিংবা সোডা দেয়ার কোনো প্রমাণ মেলেনি। সেখানে মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই পড়ে থাকার দৃশ্য চোখে পড়ে।
করোনা ইউনিট লাগোয়া ভবনটির দক্ষিণ পাশে মূল সড়কের পাশে এসব বর্জ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে। ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের বোতলসহ অন্যসব জিনিসপত্র সেখান থেকে পথশিশুরা সংগ্রহ করে ভাঙারি দোকানে বিক্রি করছে। জানা যায়, ২০০৩ সালে একটি ইনসেনেটর বরাদ্দ হলেও সেটি বসাতে আপত্তি তোলে পরিবেশ অধিদফতর। বহু চিঠি চালাচালির পর ২০০৯ সালে সেটি হাসপাতালে চত্বরে বসানো হয়। হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন বলেন, ঘণ্টায় ২৫ লিটার কেরোসিন লাগত সেটি চালাতে। এতে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ কেজি বর্জ্য পোড়ানো যেত। কিন্তু এ মেশিন দিয়ে শেবাচিম হাসপাতালের দৈনিক উৎপন্ন কয়েক টন বর্জ্যরে কোনো সুরাহা করা যেত না। এর ওপর কেরোসিনের ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তোলে ঢাকা। ফলে সেটি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় তৎকালীন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বন্ধ থাকতে থাকতে একসময় সেটি নষ্ট হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, বহু বছর ধরে হাসপাতালের জন্য ইনসেনেটর এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যন্ত্র চেয়ে আসছি। কিন্তু তা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, মান্ধাতার আমলের ইনসেনেটর হওয়ায় জটিলতার সৃষ্টি হয়। অথচ এটি প্রায় দুই কোটি টাকায় কেনা হয়েছিল।
বরিশালের পরিবেশ ফেলো মুরাদ আহম্মেদ বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে শুধু বর্জ্য তুলে এনে অন্যত্র ফেলে রাখা নয়। নিয়মানুযায়ী সব বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা। প্রথমে বর্জ্য তিন ভাগে ভাগ করতে হয়। সংক্রমক বা অতি বিপজ্জনক, সাধারণ বিপজ্জনক এবং সাধারণ বর্জ্য বাছাই করতে হয়। এরপর ক্যাটাগরি অনুযায়ী সেগুলো নিয়ম ও সময় মেনে পুড়িয়ে ফেলে ইনসেনেটর। কিন্তু বরিশালে একটিও ইনসেনেটর নেই। পুড়ে না ফেলে কেবল ফেলে দেয়ায় নগরীর কাউনিয়ায় ডাম্পিং জোনের আশপাশের বাসিন্দারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। শ্বাসকষ্টসহ নানা চর্ম ও পেটের পীড়ায় ভুগছেন তারা। বরিশালে ইটিপি কিংবা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্য কোনো উপায়ও নেই।
শেবাচিমের দুই চিকিৎসক অভিযোগ করে বলেন, গত আড়াই মাসেরও বেশি সময় হাসপাতালের বর্জ্য নিচ্ছে না সিটি কর্পোরেশন। ফলে গর্ত করে ফেলতে হচ্ছে বর্জ্য।
এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের কনজার্ভেন্সি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, নিয়মানুযায়ী হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। মেডিকেল বর্জ্যরে মতো ঝুঁকিপূর্ণ আবর্জনা নেয়ার কোনো বিধান আমাদের নেই। এছাড়া আমরা ওই বর্জ্য নিয়ে ফেলব কোথায়? যেখানেই ফেলব, সেখানেই তো ঝুঁকির মুখে পড়বে মানুষ।
সূত্র: যুগান্তর