মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:৪৪ পূর্বাহ্ন
নিরাপদ বাহন হিসেবে যাত্রীদের পছন্দের শীর্ষে ট্রেন। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনায় সেই বাহনই এখন যাত্রীদের কাছে হয়ে উঠছে আতংক। ঘন ঘন দুর্ঘটনার ফলে রেলপথে যাত্রায় মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। ফলে সরকারি এই সেবাখাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত বিশ্ব রেল দুর্ঘটনা রোধে নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও বাংলাদেশের রেলে এখনও সেই প্রযুক্তি ব্যবহার সংযোজিত হয়নি। ফলে রেল দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকা, রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, স্লিপার, নাট-বল্টু চুরি হওয়া, আধুনিক প্রযুক্তির কন্ট্রোল ব্যবস্থা না থাকা ও দক্ষ প্রশিক্ষিত চালকের অভাবেই রেল দুর্ঘটনা ঘটছে।
তবে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্ঘটনা রোধে রেলের অনেক বিধিবিধান রয়েছে, সেগুলো মেনে চলতে পারলে বর্তমান পদ্ধতিতেই দুর্ঘটনা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
একটি বেসরকারি গবেষণা বলছে, মূলত ২০১০ সাল থেকেই বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনা বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরেই বাংলাদেশের রেলপথে প্রায় দুই হাজার ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় আড়াই শতাধিক যাত্রী। আহত হয়েছেন হাজারো।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়েকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। উন্নয়ন বাজেটেও অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর পরেও তেমন কোনো সুফল মিলছে না। রেলকে ঢেলে সাজানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
রেলের হিসাব মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট এক হাজার ৯৩টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর ২০১৪ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮৬৮টি। সব মিলিয়ে গত ১০ বছরে মোট এক হাজার ৯৬১টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে রেলের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬৩ জন।
সবশেষ গত সোমবার (১২ নভেম্বর) দিনগত রাত ৩টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা-নিশীথা ও সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন দু’টির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ১৬ জন ট্রেনযাত্রী নিহত হন। এর আগে গত ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে আরও চারজন নিহত হন।
ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত রেলওয়েতে এক হাজার ৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১৫ জন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ২০১৮ সালে সড়ক-রেল-নৌপথ ও আকাশপথে ৬ হাজার ৪৮টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ৭৯৬ জন। একই সঙ্গে এ দুর্ঘটনায় আরও ১৫ হাজার ৯৮০ জন আহত হয়েছেন।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের গবেষণায় উঠে এসেছে, ট্রেন দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে লাইনচ্যুতির ৭৫ শতাংশই ঘটছে রেললাইনের কারণে। এর অন্যতম কারণ যন্ত্রাংশের সংকট ও রেলপথের যন্ত্রপাতি চুরি। রেলপথে পর্যাপ্ত পাথরের অভাব এবং ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা।
গবেষণা বলছে, সারাদেশে দুই হাজার ৯২৯ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মানসম্পন্ন রেললাইন মাত্র ৭৩৯ কিলোমিটার। যা মোট রেললাইনের ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেল গবেষক ও ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আতিকুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে যেসব ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রযুক্তির মাধ্যমে তা রোধ করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের রেল সেই সক্ষমতা অর্জন করেনি।
তিনি দুর্ঘটনা রোধে রেল কর্তৃপক্ষের রেলের গতি কমানোর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসারও পরামর্শ দেন।
জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. মিয়া জাহান বলেন, দুর্ঘটনা রোধে রেলওয়ের অনেক বিধিবিধান রয়েছে। সেই বিধিবিধানগুলো মানা হয় না বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। বিধিবিধানগুলো মানা হলে দুর্ঘটনা ঘটবে না।
আরও পড়ুন এখানে ক্লিক করে:নাম-পরিচয় মিলেছে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৬ জনের