শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৬ অপরাহ্ন
ক্রাইমসিন২৪ অনলাইন ডেস্ক: ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল জনরায়ে নগরপিতা নির্বাচিত হয়েছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন, চট্টগ্রামকে ক্লিন ও গ্রিন সিটিতে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি সম্বলিত ৩৬ দফা নির্বাচনী ইশতেহারও দিয়েছিলেন তিনি।
দায়িত্ব গ্রহণের ৪ বছর পূর্তির প্রাক্কালে তিনি এসব প্রতিশ্রুতির কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন- সে হিসেব কষতে পুরো রমজান মাস জুড়ে নগরের ৪১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন। এসব বৈঠকে প্রতিটি ওয়ার্ডে গত ৪ বছরে কি কি উন্নয়ন হয়েছে এবং কি কি সমস্যা এখনও বিরাজমান, তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। আগামি এক বছরের মধ্যে সমস্যাগুলো জরুরি ভিত্তিতে সমাধানের নির্দেশনা দিচ্ছেন মেয়র।
নগরবাসীর দুঃখ জলাবদ্ধতা নিরসনে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই উদ্যোগ নেন। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নিয়মিত নালা ও খালের আবর্জনা পরিষ্কার করা শুরু হয়। পরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৭ সালে সরকার চারটি প্রকল্পে ১০ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে সিডিএ বাস্তবায়ন করছে ৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার দু’টি প্রকল্প। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। চসিক পেয়েছে ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকায় বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী খাল খননের দায়িত্ব। এ প্রকল্পে নালা-নর্দমা ও খালের পুনঃখনন, বাঁধ নির্মাণ, জোয়ার প্রতিরোধক ফটক, খালের দুইপাশে প্রতিরোধক দেয়াল, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মূলত জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব চলে যায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হাতে। এরপরও সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্বৈততা পরিহার ও সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) নবনিযুক্ত সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষের সঙ্গে বৈঠকে মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য সিডিএ, চসিক, চট্টগ্রাম ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সব সেবা সংস্থাকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২০ সালের জুন মাসে। এ সময়ের মধ্যেই কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায় নগরবাসী।
জামালখান হেলদি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন বলেন, একসময় নগরের বিভিন্ন এলাকায় ডাস্টবিনের বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো ময়লা-আবর্জনা। মেয়রের উদ্যোগে শুরু হয় এসব ডাস্টবিন উচ্ছেদ কার্যক্রম। বিনিময়ে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হয় ৯ লাখ ময়লা রাখার প্লাস্টিক বিন। মেগা প্রকল্পের আওতায় প্রতিদিন এক হাজার ৯শ’ জন সেবক রাতেই নগরের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে থাকে। এছাড়া ডোর টু ডোর কর্মসূচির আওতায় ভ্যানগাড়িতে বাসা-বাড়ির ময়লা-আবর্জনাও নিয়ে যাচ্ছে পরিচ্ছন্নকর্মীরা।
যেসব এলাকার ফুটপাত দিয়ে দুর্গন্ধে হাঁটাচলা যেত না, সেখানে এসেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় সাজছে নগর। ইতোমধ্যে এয়ারপোর্ট রোড, টাইগারপাস রোড, লালখান বাজার, কাজীর দেউড়ী, আউটার স্টেডিয়াম, আন্দরকিল্লা, জামালখান, চট্টেশ্বরী ও প্রবর্তক মোড় এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়কে নৌকার ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিনন্দন ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে। জাতিসংঘ পার্ক সংস্কার হয়েছে। নগরজুড়ে চলছে সবুজায়নও।
আলকরণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেক সোলেমান সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, একসময় নগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঢেকে গিয়েছিল বড় বড় বিলবোর্ডে। দায়িত্ব গ্রহণের পর মেয়রের নির্দেশে শুরু হয় এসব বিলবোর্ড উচ্ছেদ। বলা যায়, নগর এখন প্রায় জঞ্জালমুক্ত। সড়কের পাশে বসেছে এলইডি লাইট, অন্ধকার রাস্তা হয়েছে আলোকিত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় শতভাগ সাফল্য এসেছে। এছাড়া ফুটপাত দখলমুক্ত করে হকারদের শৃঙ্খলায় নিয়ে আসাকেও মেয়র নাছিরের সাফল্য হিসেবে দেখছেন নগরবাসী।
শহরের সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করছেন মেয়র। এরই অংশ হিসেবে ফুটপাতগুলোকেও নান্দনিক করা হচ্ছে, পথচারীদের বসার জায়গা করে দেয়া হচ্ছে। নিউ মার্কেট থেকে পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন সড়ক, জিপিও এবং শাহ আমানত শপিং কমপ্লেক্স পর্যন্ত এলাকার প্রায় ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার রাস্তার মিড আইল্যান্ড ও ফুটপাথের সৌন্দর্য্যবর্ধন করা হচ্ছে। এম এ আজিজ আউটার স্টেডিয়ামের পূর্ব এবং উত্তর পাশে ফুটপাতসহ বাগান নির্মাণ করে বিউটিফিকেশন করা হয়েছে। নগরের রাস্তায় আইল্যান্ড, গোলচত্বর, ফুটপাত ও সড়ক দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। কয়েকটি স্থানে যাত্রী ছাউনিও স্থাপন করা হয়েছে। এসব স্থাপনায় জনসচেতনতামূলক সরকারি নির্দেশনা প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নগরের গুরুত্বপূর্ণ পোর্ট কানেকটিং রোড, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড সংস্কার কাজও নিয়মিত তদারকি করছেন মেয়র। বঙ্গবন্ধুর নামে পোর্ট কানেকটিং রোডের নামকরণ এবং সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য।
চসিক কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ওয়াসা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ সেবা সংস্থার রোড কাটিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতায় সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। মূলত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পথ চলতে হচ্ছে। এরপরও বিভিন্ন সেক্টরে অধিকাংশই সফলতা এসেছে।
মেয়র বলেন, চার বছরে শহরের সড়ক সংস্কার ও নতুন নতুন রাস্তাঘাট করেছি। ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা সংস্কার এবং কার্পেটিং কাজে ব্যবহৃত কংক্রিট, পাথর ও বিটুমিন মিশ্রিত উপাদান তৈরির আধুনিক অ্যাসফল্ট প্ল্যাণ্ট স্থাপন করেছি। শহরে প্রয়োজনের তুলনায় এক চতুর্থাংশ ড্রেন ছিল। দায়িত্ব গ্রহণের পর পর্যায়ক্রমে পুরোনো ড্রেনগুলো সংস্কার এবং নতুন আরসিসি ড্রেন করা হয়েছে। অনেক জায়গায় ড্রেনের ওপর স্ল্যাব দিয়ে ফুটপাত করা হয়েছে। ফুটপাতে টাইলস লাগানো হচ্ছে। যানজট নিরসনে যানবাহনের জন্য সড়কে জায়গা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বাস–ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণে প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে।
ক্লিন ও গ্রিন সিটির রূপকার আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, আমার প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল চট্টগ্রামকে একটি পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে গড়ে তোলা। দায়িত্ব নেয়ার পর আমি গ্রিন সিটি ক্লিন সিটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করি। এই প্রকল্পের আওতায় অনেকগুলো ময়লা ফেলার গাড়ি ও যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে এবং দৈনিক ভিত্তিতে পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রাতের বেলায় ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তারা। ডোর টু ডোর ওয়েস্ট কালেকশন করা হচ্ছে। এর ফলে নগর আগের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধমুক্ত হয়েছে। নগরের কাঁচা বাজারগুলোকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে, পাহাড়-নদী-সমুদ্রে ঘেরা নগর থেকে উচ্ছেদ হয়েছে বিলবোর্ড। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও এখন দৃশ্যমান।
এক বছর আগেও আউটার স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশের এলাকাটি ছিল জঞ্জালে ভরা। নেশাখোর, ভবঘুরে আর ভাসমানদের দখলে থাকা এ এলাকা দিয়ে হেঁটে যেতে ভয় পেত মানুষ। মেয়রের উদ্যোগে ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে ১১ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে সেখানে নির্মিত হয়েছে আন্তর্জাতিকমানের সুইমিং পুল।
মেয়র বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রতিবছর স্বাস্থ্যখাতে ১৩ কোটি এবং শিক্ষাখাতে ৪৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু নগরবাসীর কাছ থেকে গৃহকর বাবদ এই ভর্তুকির টাকাও আসছে না। তারপরও আমাদের সফলতা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অনেক। ইপিআই টিকা কার্যক্রমে আমরা একাধিকবার পুরস্কার পেয়েছি। সমস্যার পাহাড় আর সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা দেনা নিয়ে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। দুর্নীতি অনিয়মে ভরা ছিল প্রতিষ্ঠানটি। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সবগুলো সেক্টরে পরিবর্তন আনতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছি। এখন রাজস্ব আয়ও বেড়েছে।
২০১৫ সালের ৬ মে মেয়র হিসেবে শপথ নেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। ওই বছরের ২৬ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। মাসে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা সম্মানী পেলেও সেই টাকা দান করেন অটিজম স্কুল, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অসহায় শিক্ষার্থী ও অসুস্থ রোগীদের জন্য।
মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, আমি রাজনীতি করছি নগরবাসীর কল্যাণের লক্ষে। কিছু পাওয়ার জন্য মেয়র হইনি, দেওয়ার জন্য এসেছি। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। অসহায়দের কল্যাণে আমার সম্মানীর টাকা ব্যয় হচ্ছে- এটা আমার জন্য আনন্দের। আমি সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভেতরে থেকেই দায়িত্ব পালন করতে চাই।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বর্তমানে চার হাজার ৯৭ জন অস্থায়ী এবং দুই হাজার ৯৬১ জন স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। ঈদ উপলক্ষে তাদের মোট পাঁচ কোটি ১৮ লাখ ৩১ হাজার ১৮ টাকা বোনাস দেয়া হয়েছে।
আ জ ম নাছির উদ্দীন স্কুলজীবন থেকে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও নগর ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৩ ও ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হন। তিনি পর পর দুইবার মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। রাজনীতির বাইরে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক ফোরামের সভাপতি।