শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪০ পূর্বাহ্ন
আইনস্টাইন যাকে ‘ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা’ বলেছিলেন, এ বার সেই অদ্ভূতুড়ে কাণ্ডের মাধ্যমেই একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়ে দিল চীন। মহাকাশ থেকে। ১ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে থাকা পৃথিবীর দু’টি জায়গার মধ্যে বার্তা চালাচালি করে। যা এর আগে আর সম্ভব হয়নি।
যে বার্তা পৃথিবীর ওই দু’টি জায়গায় বসে থাকা দু’টি মানুষ ছাড়া কোনও তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষে জানা সম্ভব হবে না কোনও দিনই। এমনকী, দুই ব্যক্তির সেই ‘কথা চালাচালি’ আগামী দিনে অত্যন্ত শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমেও গোপনে জেনে ফেলা সম্ভব হবে না।
ফলে, ভবিষ্যতে বিশ্বে এমন টেলিযোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, যার মধ্যে অসম্ভব পারদর্শী কোনও হ্যাকারও ঢুকে পড়তে পারবে না। লক্ষ কোটি বার চেষ্টা করেও। আমাদের তথ্যের গোপনীয়তা ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হবে।
যুগান্তকারী পরীক্ষার গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ। ১৫ জুন সংখ্যায়।
হ্যাকারদের ভয়ে কাঁপছে যখন গোটা বিশ্ব, ব্যাংকের আমানত থেকে ব্যক্তিগত তথ্যাদির গোপনীয়তার সুরক্ষা নিয়ে আমাদের আশঙ্কা যখন উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে, তখন চিনা বিজ্ঞানীদের এই সফল পরীক্ষা জোরালো আশার আলো দেখাল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
পরীক্ষাটি চালানো হয়েছে ৫০০ কিলোমিটার উপরে পৃথিবীর একটি কক্ষপথে থাকা উপগ্রহের মাধ্যমে। যার নাম- ‘মিকিয়াস’। উপগ্রহটি পদার্থের একটি বিশেষ অবস্থা তৈরি করেছিল। যার নাম- ‘কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট’। আইনস্টাইনের চোখে যা ছিল- ‘স্পুকি অ্যাকশন (ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা)’।
পরিকল্পনাটি ছিল চিনের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক জিয়ান-ওয়েই পান ও তার সহযোগী গবেষকদের।
কীভাবে এটা করলেন চিনা বিজ্ঞানীরা?
ভারতের এলাহাবাদের ‘হরীশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচআরআই)’-এর অধ্যাপক উজ্জ্বল সেন জানান, মিকিয়াস উপগ্রহটি কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেল্ড অবস্থায় থাকা দু’টি আলোর কণা ‘ফোটন’ পাঠিয়েছিল ৫০০ কিলোমিটার নিচে পৃথিবীর দু’টি কেন্দ্রে। যাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল ১ হাজার ১২০ কিলোমিটার। দু’টি ফোটনই ছিল এনট্যাঙ্গেল্ড অবস্থায়। তাতে একটি কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে বার্তা পৌঁছে গিয়েছে। যে-বার্তা কোনও তৃতীয় পক্ষের পক্ষে জানা সম্ভব নয় কোনও কালেই।
‘এই ওয়ান-টু-ওয়ান এনক্রিপশন কোনও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষেও ভাঙা সম্ভব নয়’, বলছেন উজ্জ্বল।
গবেষকরা এর আগেও ২০১৭ সালে এমন একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন বেজিং ও ভিয়েনার মধ্যে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে। কিন্তু তাতে হ্যাকিংয়ের আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, হ্যাকার বা গুপ্তচররা যদি সে ক্ষেত্রে উপগ্রহটির যোগাযোগব্যবস্থাকে হ্যাক করার সুযোগ পেত, তা হলে আর বেজিং ও ভিয়েনার মধ্যে চলা সেই টেলিকনফারেন্সের যাবতীয় খবর তাদের অজানা থাকত না।
অধ্যাপক জানিয়েছেন, জানাচ্ছেন, দিনকয়েক আগেই একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল পদার্থের এমন অবস্থা বানিয়েছিল মহাকাশে। ‘স্পুকি’ উপগ্রহে। কিন্তু তার মাধ্যমে পৃথিবীর দু’টি কেন্দ্রের মধ্যে বার্তা পাঠাতে পারেননি।
মহাকাশ থেকে এই পরীক্ষার বাড়তি সুবিধা কোথায়?
অধ্যাপক উজ্জ্বল বলেন ‘পৃথিবীতে ফোটনকে বায়ুমণ্ডলের বাধা পেরিয়ে এগোতে হয়। তার ফলে, ‘নয়েজ’-এর আশঙ্কা থাকে। কিন্তু মহাকাশে হাওয়া, বাতাস নেই। ফোটন কণাকে কোনও তেমন কোনও বাধার মুখে পড়তে হয় না। এর পর গবেষকরা পৃথিবী থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে থাকা উপগ্রহে এই কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেল্ড অবস্থা তৈরির কথা ভেবেছেন। তাতে মহাকাশ থেকে বার্তা পাঠানোর জন্য পৃথিবীর দু’টি কেন্দ্রে মধ্যে দূরত্বও অনেক বাড়ানো যাবে। ওঁরা সেই দূরত্বটা ১ হাজার কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার কিলোমিটার করবেন। আর উপগ্রহটিকেও রাখা হবে ১০ হাজার কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে।’’
কেন বাড়ানো হবে দূরত্ব?
বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য, দু’জনের মধ্যে বার্তা চালাচালির সুরক্ষা কতটা দূরত্ব পর্যন্ত ১০০ শতাংশ সুনিশ্চিত করা যাচ্ছে, সেটা দেখা।