মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৩৮ পূর্বাহ্ন
দেহখানা হাড্ডিসার। পা-মাথা একাকার। দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো। গায়ে ছালার চট মোড়ানো। দূর থেকে মনে হবে চালের বস্তা।
কিন্তু মানুষ শুয়ে আছে, দেখে তা বোঝার উপায় নেই। বস্তায় মোড়ানো বৃদ্ধ অনিল চন্দ্র দে এভাবেই দুই দিন পড়ে ছিলেন ভাটিখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায়। তবে যারাই তার পাশ ঘেঁষে গেছেন, শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েছেন।
উত্তাল মার্চ, তখন করোনার প্রকোপ চরমে। তাই কেউ এগিয়ে আসেননি, বৃদ্ধের পাশেও দাঁড়াননি। কেউ একজন মুঠোফোনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) এস এম অজিয়র রহমানকে জানালেন। শুনেই পাঠিয়ে দিলেন গাড়ি, তাতে করেই বৃদ্ধা পৌঁছে গেলেন সদর হাসপাতালে। দীর্ঘ ছয় মাস চিকিৎসা শেষে বৃদ্ধা অনিলের এখন ঠাঁই হচ্ছে আগৈলঝাড়া বৃদ্ধা নিবাসে।
অনিলের জীবনের অচল চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। কিন্তু নিলুফার কী হবে? হ্যাঁ, তাঁরও জীবনের পরিবর্তন হয়েছে জেলা প্রশাসকের বদৌলতে। দুই সন্তান ঢাকায়, মা নিলুফা বেগম থাকতেন একাকী ছোট্ট ঝুপড়িঘরে। আশপাশের মানুষের কাছে হাত পেতে নিজের খাবার জোগাড় করতেন।
করোনাকালে কারো বাড়িতে পা ফেলা নিষেধ। তাই দুই দিন ধরে না খেয়ে ছিলেন নিলুফা। ক্ষুধায় ছটফট করছেন। বরিশাল সদর উপজেলার প্রত্যন্ত টুমচরের এই ঘটনাটি জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমানের নজরে আসে। নিজ উদ্যোগে নিলুফার বাড়িতে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার পৌঁছে দেন। ওষুধ আর বাজারের জন্য তাঁর হাতে নগদ অর্থ তুলে দেন। ঘূর্ণিঝড় সহনশীল ঘর নির্মাণ, বিধবা ভাতা প্রদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে নিলুফাকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
বৃদ্ধ অনিল কিংবা শুধু নিলুফা নন, তাঁদের মতো অন্তত ৩৮টি অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান। জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৮ জন সহায়তা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।
কেউ বা স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। যারা ইতিপূর্বে সরকারের গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কোনো কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না- এমন পরিবারগুলোকে মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অসহায়দের জন্য জেলা প্রশাসকের গৃহীত ‘সহায়’ অলিখিতভাবে প্রকল্প হিসেবে রূপ নিয়েছে। মানবিক সহায়তা পাওয়া পরিবারগুলোর পুরো তথ্য রক্ষিত আছে।
প্রতিবন্ধী নরসুন্দর বিমল চন্দ্র রায়ের শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে বৈশাখী রায়। বৈশাখী এখন আর পরিবারের বোঝা নন। জেলা প্রশাসকের দেওয়া ল্যাপটপে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে নিচ্ছেন।
পাশাপাশি পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে ল্যাপটপ সহযোগিতা করেছে। বৈশাখী জানান, ভার্চুয়াল জগতে উচ্চতা কোনো বিষয় নয়। ১৬ বছর বয়সে আমার উচ্চতা তিন ফুট কেউ তা জানতে চান না।
আমি ইন্টারনেটে কাজ বুঝি কি না সেটাই দেখার বিষয়। জেলা প্রশাসক মহোদয় ল্যাপটপ দিয়ে আমাকে প্রতিবন্ধিতার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। স্যারের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তাঁর মানবিক সহায়তার হাত আরো প্রসারিত হোক।
সত্তরোর্ধ্ব ফুলবানু বেগম। মানসিক প্রতিবন্ধী একমাত্র সন্তান জাহাঙ্গীর। তিন যুগ আগে অসহায় ফুলবানুকে একা রেখে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করেছেন। একখণ্ড জমিই তাঁর সম্বল। প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে সেই জমিতেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। একটু বৃষ্টিতেই ঘরে থইথই পানি। একদিকে ক্ষুধার তাড়না, অন্যদিকে ভাঙা বসত- অসহায়ত্বের সর্বশেষ মাত্রা ছুঁয়েছে। জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান নিজ উদ্যোগে ফুলবানুকে একটি ঘর তুলে দিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র বলেন, মানবিক বিষয়গুলো যখন নজরে আসে, তখনই বিবেকের তাড়নায় বঞ্চিতদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। এভাবে আমরা সবাই যদি বঞ্চিতদের পাশে গিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াই, তাহলে সমাজের চেহারাটাই পাল্টে যাবে। কারণ সরকারের একার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব না। সবাই সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে।