বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০২:১৯ পূর্বাহ্ন
একদিকে করোনার আগ্রাসন অন্যদিকে বৈষম্য। এই দুই মিলিয়ে প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে বরিশালের লঞ্চ শিল্প। মাসের পর মাস ধরে বন্ধ লঞ্চ চলাচল, উপার্জন নেই এক টাকাও। বিপরীতে লাখ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণের কিস্তি, শ্রমিকদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক সকল খরচ। সবমিলিয়ে আত্মহত্যা করার অবস্থায় বরিশালের লঞ্চ মালিকরা।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারী প্রণোদনাসহ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে কোনভাবেই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন লঞ্চ মালিকরা। তাদের দাবি স্বল্প সুদে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের ঋণ প্রদান করা হোক। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব জানিয়েছেন, লঞ্চ মালিকদের প্রণোদনার বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশের সবচেয়ে বড় নৌরুট হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল নৌরুট। স্বাভাবিকভাবেই এ রুটকে কেন্দ্র করে যাত্রীসেবায় যুক্ত হয়েছে বিলাসবহুল সব লঞ্চ। একক দৃষ্টিতে শুধু লঞ্চ ব্যবসায়ী নয়, দিনে দিনে এটি একটি শিল্পতে রূপ নিয়েছে।
ফলশ্রুতিতে বরিশালে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। এসব অত্যাধুনিক নৌযান আঞ্চলিকভাবে এসব ডকইয়ার্ডেই তৈরি করা হয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে হাজার হাজার শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমানে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে আটটি কোম্পানির ২৩টি লঞ্চ চলাচল করছে। প্রায় সবগুলোই তিন থেকে চারতলাবিশিষ্ট। অত্যাধুনিক লঞ্চগুলো তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা। যারমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা থাকে ব্যাংকঋণ। মাসিক ও ত্রৈমাসিক হিসেবে কিস্তি পরিশোধের চুক্তিতে উচ্চসুদে সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন মালিকরা। ঋণের ধরন হিসেবে প্রত্যেক লঞ্চ মালিককে মাসে লাখ লাখ টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।
অথচ করোনার কারণে দীর্ঘসময় উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকলেও ব্যাংক তথা ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিস্তি স্থগিতও করেনি বা সুদের হারও কমায়নি। এমন অবস্থায় এককথায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন লঞ্চ মালিকরা। সূত্রে আরও জানা গেছে, করোনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৭ মাস সরকারী নির্দেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই বন্ধ রয়েছে উপার্জন কিন্তু নিয়ম মেনে যথারীতি পরিশোধ করতে হচ্ছে ভ্যাট ও ট্যাক্স। বাদ যায়নি যাত্রী কল্যাণ ফান্ডে টাকা প্রদান। শ্রমিকদের বেতন-বোনাসও পরিশোধ করতে হয়েছে মানবিক বিবেচনায়। কিন্তু লঞ্চ মালিকদের কথা বিবেচনা করেনি কেউ। কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও সুন্দরবন নেভিগেশনের স্বত্বাধিকারী আলহাজ সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, সরকার করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লঞ্চ মালিকরা সরকারের সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
অথচ অগ্রাধিকার হিসেবে লঞ্চ শিল্প সর্বাগ্রে প্রাপ্য ছিল। তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক লঞ্চ মালিকের শত কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ রয়েছে। যাদের নির্দিষ্ট হারে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু গত একবছর ধরে উপার্জনই নেই। তাহলে আমরা কিভাবে চলি। মেসার্স সালমা শিপিং ও কীর্তনখোলা লঞ্চের স্বত্বাধিকারী মঞ্জুরুল আহসান ফেরদৌস বলেন, লঞ্চ ব্যবসা মানেই ঋণের বোঝা। আমরা কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে লঞ্চ তৈরি করে যাত্রীদের মনোরম সেবা দিয়ে আসছি। কিন্তু করোনার দুঃসময়ে সরকার আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে ঋণের বোঝায় আমাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, গত বছর পাঁচ মাস এবং চলতি বছর এখন পর্যন্ত দুইমাস, এই সাত মাসে আমাদের এক টাকা উপার্জন নেই। অথচ সময়মতো ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে, শত শত স্টাফের বেতন, ভ্যাট ট্যাক্স সবই দিতে হয়েছে।
একটি জায়গা থেকেও আমরা মাফ পাইনি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকার করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ সেক্টরে প্রণোদনা দিয়েছে কিন্তু লঞ্চ শিল্প কোন ধরনের প্রণোদনার আওতায় আসেনি। তাহলে আমরা বা এই শিল্প কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি? নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, লঞ্চ মালিকদের প্রণোদনার বিষয়টি সরকার ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিষয়টির সমাধান হবে। এ জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি তিনি লঞ্চ মালিকদের নিয়ে বসে আলোচনা করবেন। তারপরই সিদ্ধান্ত হবে কি ধরনের প্রণোদনা প্রদান করা হবে।