বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৮ পূর্বাহ্ন
বরিশাল জেলা সংলগ্ন ইলিশের অভয়াশ্রম মেঘনা তীরে অনুমোদনহীন শত শত মাছঘাট স্থাপন করে মৎস্যনির্ভর সব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। বৈধ-অবৈধ সব ধরনের মাছ নিধন করে এক মৌসুমেই লাখপতি হচ্ছেন মেঘনা তীরের প্রভাবশালী মাছঘাট মালিকরা। ২০০১ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট আমলে চালু হওয়া এ রেওয়াজ এখনও চলছে। সম্প্রতি হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
মেঘনার ২২ কিলোমিটার বয়ে গেছে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা উপজেলার পাশ দিয়ে। এটি ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম। প্রতিদিন হাজার হাজার জেলে এখানে ইলিশ শিকার করেন। চিংড়ির রেণু ধরা নিষিদ্ধ হলেও বছরের চৈত্র-বৈশাখ মাসে রেণু নিধনের ধুম পড়ে সেখানে। শুধু ইলিশ ও চিংড়ির রেণুতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয় মেঘনা তীরের এই জনপদে। এ ব্যবসা কেন্দ্র করে ২০০১ সালের পর দুই উপজেলার মেঘনার তীরে গড়ে উঠেছে শত শত মাছঘাট। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের স্থানীয় নেতারা হন এই মাছঘাটের মালিক।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও হিজলার ধুলখোলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন মাতুব্বর বলেন, নদীর তীরের প্রতিটি মাছঘাট একটি করে ‘জেলে শোষণের ঘর’। এগুলোর সরকারি অনুমোদন নেই। দাদন হিসেবে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে জেলেদের জিম্মি করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের সিন্ডিকেট করা মূল্যে সেখানে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হন জেলেরা। জেলেদের মাছ বিক্রির টাকার ১০ শতাংশ কমিশন রাখেন মাছঘাট মালিক। এভাবে প্রতি মৌসুমেই মাছঘাট মালিকরা লাখ লাখ টাকা মুনাফা করছেন। প্রশাসন ম্যানেজ করে মেঘনায় আহরণ নিষিদ্ধ জাটকা (১০ ইঞ্চির কম সাইজের ইলিশ) ও চিংড়ির রেণু পোনা নিধনেও জেলেদের বাধ্য করেন ওই অবৈধ মাছঘাট মালিকরা।
জানা গেছে, মৎস্যনির্ভর কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ জনপ্রতিনিধির আস্থাভাজন স্থানীয় নেতারাই হন মেঘনার শাসক। অল্প সময়ের মধ্যে অর্থে-বিত্তে শক্তিশালী হয়ে তারাই হন দুই উপজেলায় বড় দুটি রাজনৈতিক দলের চালিকাশক্তি। মেঘনা তীরের জনপদে জনপ্রতিনিধিও হন তারা। জলদস্যু থেকে জনপ্রতিনিধি ও বড় রাজনৈতিক দলের উপজেলার প্রভাবশালী নেতা হওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে এই দুই উপজেলায়।
ওই এলাকায় মাছের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্নিষ্টরা জানান, ২০০৯ সাল থেকে দুই উপজেলার মেঘনা নিয়ন্ত্রণ করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আধিপত্য নিশ্চিত করতে স্থানীয় নেতাদের জোনভিত্তিক এলাকা ভাগ করে দিয়েছেন সেখানকার শীর্ষ জনপ্রতিনিধি।
স্থানীয়রা জানান, মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া ইউনিয়নের সুলতানী গ্রাম থেকে হাসানপুর গ্রাম সংলগ্ন মেঘনার নিয়ন্ত্রক ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিঠু চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন রাজু। হাসানপুর থেকে হিজলার ধুলখোলা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন ধুলখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কালাম বেপারী। মেঘনার পূর্বপ্রান্ত গোবিন্দপুর এলাকার নিয়ন্ত্রক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সামসু কাজী, ইউপি মেম্বর জয়নাল ও কৃষ্ণা। হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মিলনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ওই উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়ার মেঘনার বড় অংশ। ওই উপজেলার হরিণাথপুর ইউনিয়ন সংলগ্ন মেঘনা নিয়ন্ত্রণ করছেন ইউপি চেয়ারম্যান লতিফ খান ও সাবেক চেয়ারম্যান তৌফিক হোসেন। একইভাবে চারদলীয় জোটের আমলে এসব মাছ ঘাটের নিয়ন্ত্রক ছিলেন স্থানীয় বিএনপি ও ছাত্রদল নেতারা।
এ বিষয়ে উলানিয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মিঠু চৌধুরী বলেন, মেঘনার তীরে যার জমি আছে তিনিই মাছঘাট করতে পারেন। খাজনা পরিশোধের বিনিময়ে অন্যের জমিতেও মাছঘাট হয়। মাছঘাট মালিকরা দাদন হিসেবে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ১০ শতাংশ হারে কমিশন নেন। এ ব্যবসায় সরকারের কোনো অনুমোদন লাগে না। তবে রাজনৈতিকভাবে মেঘনা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, এখনও সেখানে বিএনপি নেতাদের মাছঘাট আছে ও তারা ব্যবসা করছেন।
নদীর তীরে অবৈধভাবে মাছঘাট স্থাপন ও জেলেদের জিম্মি করে প্রভাবশালীদের ব্যবসা নিয়ে জানতে চাইলে বরিশাল মৎস্য অধিপ্তরের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের কিছু করার নেই। নদীর মাছ রক্ষণাবেক্ষণ করার মধ্যেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ।