শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪০ পূর্বাহ্ন
নোট আর গাইড বই কোন ব্যাপার না। শিক্ষাটা পরীক্ষামুখী হয়ে গেছে।
শিক্ষা জিনিসটা স্কুল থেকে কোচিং সেন্টারে চলে গেছে। বইয়ের চেয়ে নোট বই গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষকের চেয়ে কোর্স গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। লেখাপড়ার চেয়ে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। জ্ঞানের চেয়ে সনদপত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এই যে বদল হয়ে গেছে, আমাদের দোষে হয়েছে। আমরা করতে দিয়েছি, এই জায়গাগুলো ঠিক করতে হবে।
শুক্রবার (৪ নভেম্বর) নগরের নন্দনকানন ফুলকি একে খান স্মৃতি মিলনায়তনে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ অর্জনে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শীর্ষক এক সেমিনারের একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমাদের আসলে দেখতে হবে, যে সমস্যাগুলো কোথায় থেকে শুরু হচ্ছে। আমরা যখন পড়ছি ৬২-৬৩ সালে স্কুলে তখন এক একটি ক্লাসে চল্লিশ পয়তাল্লিশ জন করে ছাত্র থাকতো সর্বোচ্চ, ষাটের দশকের পর থেকে এটা অল্প অল্প করে বাড়তে শুরু করেছে । তখন কোন কোন স্কুলে দুই শিফট চালু হলো কিন্তু শিক্ষক সেভাবে বাড়লো না। তারপরে স্বাধীনতার পরে ছাত্রসংখ্যা আরও বাড়তে শুরু করলো এবং সেটা বেশ দ্রুতগতিতে বেড়েছে । আশির দশকে, আপনাদের কারো কারো মনে থাকবে, আশির দশকে একটা এনাম কমিশন হয়েছিলো, এই কমিশন বলেছিলো একশো কুড়িজন যদি না হয় কোন শাখায় তাহলে আরেকটি শাখা খােলা যাবে না, আপনি ভাবুন একশো কুড়িজন ছাত্র একটি ক্লাসে সেটা যদি ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টমে হয়। তাহলে সেখানে শিক্ষকের পক্ষে ক্লাস নেয়া সম্ভব না, ছাত্রদের সাথে ইন্টারেকশনে যাওয়া সম্ভব না। ফলে তখন আবার শিক্ষকদের উপর একটা চাপ রয়েছে, যে তাদেরকে ভালো রেজাল্ট দেখাতে হবে, এটা কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করছে, তাহলে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং পরীক্ষাতে ভালো রেজাল্ট করতে পাঁচটা করে প্রশ্নের উত্তর শিখবে এর বেশি শিখলে কিন্তু তারা পারবে না।
তিনি আরও বলেন, পাঁচটা করে প্রশ্নের উত্তর ক্লাস ওয়ান থেকে শিখে যাচ্ছে, এবং আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে দেখেছি ছাত্ররা কিন্তু ওরকম নির্দিষ্ট প্রশ্নই চায়, সে তো ওপেন একটা পড়াশোনার মধ্য দিয়ে যায়নি, তার সামর্থ্যই হচ্ছে ওই অল্প কিছু জিনিস মুখস্ত করা এবং সেটা তারা কিভাবে করে, সেটা তারা একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয় যে আগামী দুই মাস পরীক্ষার জন্য আমি কোন রকম অন্য কাজ করবো না, সিনেমা দেখবো না, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবো না। তারপর মুখস্থ করে সে সেটা পরীক্ষার হলে লিখে দিয়ে আসে। তখন কি হয় একটা প্রেসারের মধ্যে দুমাসে তিন বছরের পড়া পড়লো বা এক বছরের পড়া পড়লো। কিন্তু তারপরে তার মাথায় কিছু থাকে না, তাকে তো শিক্ষাখাতে ক্যারিঅন করতে হবে, ক্লাস ওয়ান টু, থ্রি এরকম করে তাকে এভাবল যেতে হবে কিন্তু এখন তো ধারাবাহিকতা তাকে না।
সেমিনারে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের মহাপরিচালক প্রফেসর ড.এএফ ইমাম আলি বলেন, সমাজকাঠামোর ভিন্নতার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রেও পার্থক্য বিদ্যমান। বাংলাদেশে শিক্ষা এখনও সমাজকাঠামোর ওপর একটি নির্ভরশীল চলক, যেখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিষয়ক সুযোগ-সুবিধা ও অর্জন তাদের পরিবারের আর্থসামাজিক মর্যাদা দ্বারাই নির্ধারিত হয়। ইতিমধ্যেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তবে তা গুণগত মানের বিচারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় । শিক্ষাকে সময়-উপযোগী করে যৌক্তিকভাবে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা সময়ের দাবি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক সুপারনিউমারারি প্রফেসর ও বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড.এএফ ইমাম আলি বলেন, বাংলাদেশের স্তরায়িত ও শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শিক্ষা অর্জন সুযোগ সকলের জন্য সমান নয়। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা বৈষম্যমূলক। বাংলাদেশে বর্তমানে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ, শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সংক্রান্ত আয়-ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভিন্নমুখী ব্যবস্থার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি) দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ইহ-জাগতিকতা, সর্বজনীন-মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় লক্ষ করা যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক দুর্নীতি নিয়ে প্রায়ই পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হচ্ছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ক্রিয়াশীল। তা জাতির জন্য লজ্জাকর। অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, গণতান্ত্রিক, ডিজিটাল ‘সোনার বাংলা’ গড়ার সহায়ক নয়। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অবিভাবক ও সরকার করণীয় কী? তা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক নাগরিকদের চিন্তার অবকাশ রয়েছে।
সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন রবীন্দ্রকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুল আউয়াল বিশ্বাস, প্রাবন্ধিক ও গবেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক, সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ড. সুদীপ্তা দত্ত, বাকলিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. সিরাজুদ্দৌল্লা, যশোর সরকারি মাইকেল মুধুসূদন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খ.ম. রেজাউল করিম, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান মো. মজনুর রশীদ, রাঙ্গুনিয়া হাসিনা-আমাল ডিগ্রি কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্ত, বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক কানাই দাশ ও আগ্রবাদ চিলড্রেন গার্টেন স্কুলের অধ্যক্ষ আফিয়া হাসান মীরা প্রমুখ।