শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:২৫ অপরাহ্ন

সর্বশেষ সংবাদ :
জনগণের হাতে ক্ষমতা পরিবর্তনের হাতিয়ার ছিল : নুর ইফতার মাহফিলের বরিশালে সড়কের মধ্যে নির্মিত গেট উচ্ছেদের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন পটুয়াখালীতে বৃদ্ধ প্রেমিককে হত্যা, প্রেমিকা ও তার স্বামী আটক মীরগঞ্জ ফেরিঘাটের ইজারা পেলেন তালুকদার এন্টারপ্রাইজ, জনমনে স্বস্তি গলাচিপা শিক্ষা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ৫০ মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তির চেক প্রদান কলাপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা সহ চার সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখলের প্রতিকার চেয়ে সংবাদ সম্মেলন কলাপাড়ায় তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি বিষয়ক কৃষক মাঠ দিবস বরিশালে ঝোপের মধ্যে কাঁদছিলো নবজাতক, উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি বরিশালে আন্দোলন-সংগ্রামে কারাবরনকারী নেতাকর্মীদের মাঝে তারেক রহমানের উপহার ইফতার সামগ্রী বিতরন গলাচিপা নাগরিক কমিটি সভাপতি সোহরাব, সম্পাদক শংকর বরিশালে নানা আয়োজনে মহান স্বাধিনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপিত স্বাধীনতা দিবসে সাধারনের প্রদর্শনের জন্য উম্মুক্ত কোস্টগার্ড জাহাজ বিসিজিএ বগুড়া বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে মির্জাগঞ্জে পল্লীসঞ্চয় ব্যাংকে উত্তোলন হয়নি জাতীয় পতাকা বরিশালে পালিত হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দোল পূর্ণিমা উৎসব
তবে কি হারিয়ে যাচ্ছে জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি ‘ধানসিঁড়ি’?

তবে কি হারিয়ে যাচ্ছে জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি ‘ধানসিঁড়ি’?

Sharing is caring!

সাদিয়া ইসলাম, বরিশাল: আমার গুরতে যাওয়া একটি গল্প সকলের কাছে শেয়ার করা হয়ছে। স্যাঁতস্যাঁতে ইটের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। এদিক সেদিক খুঁজতে থাকি একটি বাড়ি। ঠিকঠাক জানা নেই বলে পথে নেমে পথ খোঁজার প্রয়াস। মনে মনে বুঝতে পারি, বাড়িটির কাছে চলে এসেছি। ঘন মেঘে ঢাকা আকাশ আর মাটির সোঁদা গন্ধ যেন বলে দেয়— ‘অনেক গভীর ঘাস জমে গেছে বুকের ভিতর।

তারপর দেখা মেলে সেই বাড়িটির। বড় বড় অট্টালিকা ও ঝোঁপঝাড়ে প্রায় ঢাকাই পড়ে ছিল ‘ধানসিঁড়ি’ লেখা বাড়িটি। কেমন বিষণ্ণ মেজাজ! কালের বিবর্তনে নুয়ে পড়া শ্রাবণ দিনে যেন আরও একটু ধূসর। ভেতরে পা দিতেই মনে হয়— ‘মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব বেদনার গন্ধে’ যেন ভেসে যাচ্ছে চরাচর। নির্জনতার কবি ছিলেন তিনি। সেই নির্জনতা যেন আরও ভর করে আছে ‘রূপসী বাংলা’র সেই কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি ‘ধানসিঁড়ি’ জুড়ে।

কবির বাড়ি দেখতে গিয়ে মনে হয়, এই তো সেই নদীর দেশ, কবির ধানসিঁড়ির দেশ। ‘ধূসরতা’ আর বুকে জমে থাকা ‘গভীর ঘাসে’র এই খানেই তো ‘ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে।’ হিজল নেই, তমাল নেই, তবু মনে হয়— ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে— মধুর বৃষ্টি ঝরে— ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে— রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ।’ বরিশাল শহরের বগুড়া রোডে আম্বিয়া হাসপাতালের পাশেই গাছ-গাছালি ঘেরা ছায়া সুনিবিড় একটি দরজা। দরজা ঠেলতেই চোখের সামনে লোহার গেটে লাল থামে সাদা অক্ষরে লেখা ‘ধানসিঁড়ি’। শিহরণ জাগে। এই বাড়ি যেন এক ধাক্কায় নিয়ে যায় জীবনানন্দ দাশের সময়ে। মনে হয়, এই বুঝি সাদা পাঞ্জাবি আর ধূতিতে দরজা খুলে দাঁড়াবেন কবি।

ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই। দরজা ধরে আরেকটু ভেতরে এগুলেই জীবনান্দ দাশের ভিটের শেষ স্মৃতিটুকু চোখে পড়বে, তার উত্তেজনায় বুকের ভেতর ঢেউ লাগে। ‘ধানসিঁড়ি’র এই ভিটের বয়সও কম নয়। জীবনানন্দই তো জন্মেছিলেন সেই কোন ১৮৯৯ সালে। তখন ফাল্গুন মাস। বাবা সত্যনন্দ দাশ ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও সমাজসেবক। ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। সে যুগে তো বটেই, এ যুগেও মানুষের পরিচয়ও বাবার নামে শেষ হয়।

কিন্তু জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারীও ছিলেন তখন বিখ্যাত কবি। তবে এ বাড়ি জীবনানন্দ দাশের বাবারও নয়। তার পিতামহ সর্বানন্দ দাশের নামে সেসময় নামকরণ করা হয়েছিল বাড়িটির। যদিও সর্বানন্দ দাশের বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার পদ্ম পাড়ের গাউপাড়া গ্রামে। কালেক্টরেট অফিসে চাকরি নিয়ে বরিশালে আসেন তিনি। তার ছেলে-মেয়েরা বরিশালেই বাড়ি করেন এবং বাবার নামেই রাখেন বাড়ির নাম— ‘সর্বানন্দ ভবন’।

দাদাবাড়িতে থাকলেও জীবনানন্দ দাশের শৈশব জুড়ে ছিলেন তার মা। মায়ের কাছেই হয় বাল্য শিক্ষা। তারপর ভর্তি হন ব্রজমোহন স্কুলে। ১৯১৫ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাসের পর ১৯১৭ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ শেষ করেন তিনি। ১৯১৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ পাস করেন বিএ। পরে ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করার পরের বছরেই ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতা সিটি কলেজে।

একদম যেন গল্প উপন্যাসের লক্ষ্মীপনা ছেলেটি! তবে এটুকুই জীবনানন্দ দাশের জীবনের সবটা নয়। ১৯২৯ সালে খুলনা জেলার বাগেরহাট কলেজে মাস তিনেক অধ্যাপনা করেন তিনি। এরপর ওই বছরের শেষ দিকে যোগ দেন দিল্লির রামযশ কলেজে। ১৯৩০ সালের মে মাসে চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে বিয়ে করেন।

বিয়ের পর অনেকদিন কর্মহীন জীবনযাপন করেন তিনি। ১৯৩৫ সালে আবার যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশায়। এবার নিজ ভূমি, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে। কিন্তু নিজ বাড়ি টিকে থাকা কপালে ছিল না তার। ১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই যান কলকাতা। এরপর দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। নানামুখী প্রতিকূলতার কারণেই দেশে আর ফিরে আসা হয়নি তার।

দেশভাগের পর কবি ও তার পরিবারের স্থায়ী ঠিকানা হয় কলকাতা। বেঁচে থাকতে যে কদর পাননি কবি, তা পেয়েছেন মৃত্যুর পর। কবিতার উপমা প্রয়োগে কাল ও ইতিহাস সচেতন এই কবির নৈপূণ্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দন যুক্ত করেন, যা পরবর্তী কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে, জীবনবোধকে নাড়া দিয়েছে।

কথা হয় কবির স্মৃতিবিজড়িত ‘ধানসিঁড়ি’ বাড়ির বর্তমান বসবাসকারী জলিল ফারুকের সঙ্গে। সে কথোপকথনে উঠে আসে এ বাড়িটিকে নানা অজানা কথা। বাড়ির প্রবেশ মুখের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে ‘কবি জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি মিলনায়তন ও পাঠাগার’।লাইব্রেরিয়ান জানান, বইয়ের সংকট ও প্রশাসনের সুদৃষ্টির অভাবেই এই পাঠাগার গুরুত্ব হারাতে শুরু করেছে।

বিশ্বভারতী, শান্তিনিতেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গবেষণার জন্য অনেকেই আসত আগে। কিন্তু বরিশালে কবির তেমন কোনো স্মৃতি না থাকায় এখন তেমন কেউ আর আসে না। জীবনানন্দ দাশের বসতবাড়ির আগের রূপ এখন নেই বললেই চলে। আর না থাকাটাই যেন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বর্তমানে যে বাড়িটি জীবনান্দদাশের বাড়ি বলে ধরা হয়, তার ঠিক তার বিপরীত পাশেই আরেকটি ঘর ছিল, এখন আর নেই।

এই না থাকা যেন ভবিষ্যতে এই বাড়িটির চিহ্ন একেবারেই না থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেই ইঙ্গিত যেন ‘ধানসিঁড়ি’ গল্পের ম্লান হয়ে যাওয়ার। পিলারে পিলারে গল্পের শ্রীও যেন কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। কবির আর কোনো স্মৃতি নেই যেন নেই এই তটে। একটা সময় হয়তো কেউ ভেবে বসতে পারেন, এই তল্লাটে কোনো জীবনানন্দ ছিলেন না।

বিষণ্ণ মনে ফিরতে হলো বাড়িটি থেকে। বাড়ির প্রবেশদ্বার অতিক্রম করতে না করতেই ফের সেই বৃষ্টি, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। একটু কি রোদ উঁকি দেয় কোথাও? ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ থেকে জীবনানন্দ কি বলছেন— মৃত্যুরে কে মনে রাখে?… কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস নতুন ডাঙার দিকে– পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা দিন তার কেটে যায়– শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?

Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © crimeseen24.com-2017
Design By MrHostBD