মঙ্গলবার, ০৮ Jul ২০২৫, ১০:১৬ পূর্বাহ্ন
জলবায়ু পরিবর্তনে সাগর-নদীর স্বাভাবিক জোয়ার বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের বাঁধ কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। কখনও কখনও স্বাভাবিক জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। বিশেষ করে ভরাকাটালের পূর্ণিমায় এমন ঘটনা ঘটছে। এরই মধ্যে দিনে দু’বার করে ডুবতে শুরু করেছে উপকূলের নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে যাচ্ছে বসতভিটা।
গত ৫০ বছরে সাগর-নদীর স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতা গড়ে প্রায় দুই ফুট বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এমন ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা। এ রকম পরিস্থিতিতে দক্ষিণের নদ-নদীগুলো হয়ে প্রবলবেগে নামতে থাকা উত্তরের বন্যার পানি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাইদ বলেন, জোয়ার-ভাটা ও ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের রেকর্ড বিশ্লেষণ করেই উপকূল এবং দেশের অভ্যন্তর ভাগের বেড়িবাঁধগুলোর উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সিডর থেকে শুরু করে সর্বশেষ আম্পান এবং মাঝের বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের যে রেকর্ড তাতে এসব বাঁধ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না সেটি পরিষ্কার।
পাউবোর বরিশালের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শফিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ’৭০-এর জলোচ্ছ্বাসের তুলনায় সিডরের জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল তিন থেকে চার ফুট বেশি। গত বছরের ২০ মে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় যে জলোচ্ছ্বাস হয় সেটাও ছিল ১৪ থেকে ১৫ ফুট উঁচু।
এ সময় বরিশাল বিভাগের ৭৬৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এটি অবশ্যই অ্যালার্মিং। আম্পান-পরবর্তী এক সপ্তাহে উঁচু জোয়ারে দিনে দু’বার করে ডুবেছে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। বরিশালের সাতলা-বাগদা প্রকল্পের বেড়িবাঁধগুলোও জোয়ারের পানি ছুঁই ছুঁই। কর্মকর্তাদের বক্তব্যই কেবল নয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ধারাবাহিক জোয়ার পরিমাপক শাখাও দিচ্ছে নদী-সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির তথ্য।
রেকর্ড অনুযায়ী- বিষখালী, পায়রা ও বলেশ্বরে ২০০৪ সালে স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতা ছিল তিন দশমিক ৪৫ মিটার। ২০০৫ সালে এটা গিয়ে দাঁড়ায় তিন দশমিক ৫১ এবং ২০০৬ সালে তিন দশমিক ৯৬ মিটার। ২০০৭ সালের সিডরে এ জোয়ারের উচ্চতা গিয়ে দাঁড়ায় চার দশমিক ২২ মিটার।
রেকর্ড অনুযায়ী এসব নদ-নদীর জোয়ারের স্বাভাবিক উচ্চতা মাত্র ২০-২৫ বছর আগেও আড়াই থেকে পৌনে তিন মিটারের মধ্যে থাকলেও বর্তমানে তা তিন থেকে প্রায় ৪ মিটারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাউবোর তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে ১১ হাজার ৪৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে পাঁচ হাজার ১৬০ কিলোমিটার উপকূলীয় সুরক্ষা বাঁধ। এর অধিকাংশই বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায়। এখানে ৮২টি পোল্ডারের আওতায় প্রায় তিন হাজার ৫৬২ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে।
পাউবোর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জাভেদ আহম্মেদ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। স্বাভাবিক জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে ভেতরে প্রবেশ করলে জলোচ্ছ্বাসে কি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইমেজ অ্যান্ড ইনফরমেশনের পরিচালক হাসান আবিদুর রেজা বলেন, ‘অসংখ্য নদ-নদী পরিবেষ্টিত সমুদ্রের খুব কাছের এলাকা হওয়ায় প্রায় কখনই প্লাবিত হতো না দক্ষিণ উপকূল তথা বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা। দেশের ইতিহাসে বড় বড় বন্যা হলেও কোনোটিতেই মাথা নোয়ানি দক্ষিণ। কিন্তু বর্তমানে সাগর-নদীর স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় উত্তরের ঢলের পানিতে দু’পাড় উপচে তলিয়ে যায়।
তার এ বক্তব্যের প্রমাণ মেলে গত ক’দিনে তলিয়ে যাওয়া দক্ষিণের বিস্তীর্ণ এলাকার তথ্যে। সাগর পাড়ের রাঙ্গাবালী উপজেলা থেকে পাওয়া খবরানুযায়ী, সেখানকার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের গরুভাঙ্গা, বিবির হাওলা এবং মধ্য চালিতাবুনিয়া গ্রাম দিনে দু’বার করে ডুবছে জোয়ারের পানিতে।
এছাড়া বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার খোট্টারচর, ভোলা চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ও ভদ্রপাশা এবং বাউফলের বেশকিছু এলাকাসহ উপকূলবর্তী বহু এলাকা থেকে পাওয়া গেছে প্লাবিত হওয়ার খবর। এমনকি বরিশাল-কুয়াকাটা আন্তঃমহাসড়কের লেবুখালী ফেরি পয়েন্ট এবং বরিশাল নগরী সংলগ্ন পলাশপুর এলাকাও প্লাবিত হচ্ছে জোয়ারের পানিতে। ফেরির পন্টুন ডুবে যাওয়ায় লেবুখালীতে সমস্যা হচ্ছে যানবাহন পারাপারে।
এসব বিষয় নিয়ে আলাপকালে পাউবোর পটুয়াখালী জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মজিবর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে বেড়িবাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ৮০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কোস্টাল অ্যামব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (সিআইপি) আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা ও বাগেরহাটের বেড়িবাঁধগুলো আরও এক মিটার উঁচু করার কাজ চলছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এ কাজে সফলতা পাওয়া গেলে পর্যায়ক্রমে সব বেড়িবাঁধ উঁচু করার কাজ শুরু হবে।
জানা গেছে, ৫০ থেকে ১০০ বছরের জোয়ার-ভাটা আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে নদী অথবা সাগর পাড়ের বাঁধের উচ্চতা নির্ধারণ করে পাউবো। দেশের দক্ষিণে নদী ও সাগর তীরবর্তী এলাকার বাঁধগুলোর প্রায় সবই ’৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর নির্মিত। এগুলোর স্বাভাবিক উচ্চতা চার থেকে পাঁচ মিটার। এছাড়া অভ্যন্তর ভাগের নদীতীরে নির্মিত বাঁধগুলোর স্বাভাবিক উচ্চতা এক দশমিক ৮ থেকে দুই মিটার।