বৃহস্পতিবার, ০৭ অগাস্ট ২০২৫, ১১:৩২ অপরাহ্ন
রবিউল ইসলাম রবিঃ
অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী মরিয়ম। ৭ জুলাই স্কুলে দিয়েছে ‘বাংলাদেশ ও আত্মগোপনকারী’ পরীক্ষা।
স্কুল থেকে বাড়ি যাবার পথে নিখোঁজ হয় মরিয়ম। মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে ৮ জুলাই থানায় সাধারণ ডাইরি দায়ের করেন মো. কবির হাওলাদার। হঠাৎ ১৮ দিন পর স্কুল ও বাড়ি আসা-যাওয়ার রাস্তার পাশে মিরাজের পরিত্যক্ত বসতঘরের সামনের ডোবায় ভেসে উঠে মরিয়মের স্কুল ব্যাগ।
২৫ ও ২৬ জুলাই পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে মরিয়মের স্কুল ব্যাগ ও এক পায়ের জুতা সহ শরীরের হাড় এবং মাথার খুলি। চলতি বছরের ওই তিন তারিখে বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কাজিরহাটের পূর্ব কাদিরাবাদ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
২৬ জুলাই মরিয়মের বাবা বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে কাজিরহাট থানায় একটি হ/ত্যা মামলা দায়ের করেন।
এলাকার অনেকেরই ধারণা- ধর্ষণের পর মরিয়মকে পরিকল্পিতভাবে হ/ত্যা করা হয়েছে।
পরে লাশ গুম করার জন্য ডোবায় পানি নিচে মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছে। রহস্যজনক হ/ত্যাকাণ্ডে সরেজমিন অনুসন্ধানকালে উঠে এসেছে নানা তথ্য।
নিহত মরিয়ম ১১ নং পূর্ব কাদিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮র্ম শ্রেণীর ছাত্রী। রোল নং-১১। উপজেলার দুইটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮র্ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়।
অন্যান্য দিনের ন্যায় ৭ জুলাই পরীক্ষা দিতে আসে মরিয়ম। বৃষ্টির মধ্যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে দেরি হওয়ায় সকাল সাড়ে দশ টায় পরীক্ষা শুরু হয় এবং দুপুর দেড়টায় শেষ হয়।
স্কুলের পেছনে উত্তর দিকে থেকে বয়ে যাওয়া মাটির রাস্তার প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় মরিয়মের বাড়ি।
নির্জন রাস্তা। স্কুল থেকে যাবার পথে রাস্তার ডান পাশে নেই কোন ঘরবাড়ি। রয়েছে বাগান। রাস্তার বাম পাশে শত শত গজ পর পর আলাদা আলাদাভাবে রয়েছে ৪/৫টি বাড়ি।
রাস্তাটি “নীরব নিভৃতে” থাকায় আগে থেকেই এলাকার নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাদক সেবনের একটি নিরাপদ স্পটে রূপান্তরিত হয়। প্রথম বাড়িটি হল- কালাম সরদারের (৪০)।
তিনি নানা অপরাধে কারাদণ্ড ভোগ করেছে। আগে ঢাকায় বাস করতেন। সম্প্রতি গ্রামের বাড়িতে এসে পার্শ্ববতী এলাকায় ২য় বিয়ে করে বসবাস শুরু করেন। অধিকাংশ সময়ই স্ত্রী থাকেন না বাড়িতে।
স্কুলের পাশেই মরিয়ম নিখোঁজের কয়েকদিন পূর্বে দিয়েছেন একটি চা-সিগারেটের দোকান। তার বসতঘরে প্রায়ই বসে মাদক সেবনের আসর।
ঘটনার দিন অর্থাৎ ৭ জুলাই ওই ৪/৫টি বাড়ির মধ্যে কালাম সরদারের স্ত্রী বসতঘরে ছিলেন না।
স্কুল থেকে শুরু করে মরিয়মের মরদেহ উদ্ধার করা মিরাজের পরিত্যক্ত বসতঘর পর্যন্ত পথের মধ্যে রয়েছে শুধু কালাম সরদারের বসতঘর।
পরিত্যক্ত তালাবদ্ধ ছোট বসতঘরে কেউ বসবাস করেন না। পর্যবেক্ষণকালে এ ঘরটিতে মানুষ প্রবেশ করারও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
সামনের অন্য সকল বাড়িগুলোতে যৌথভাবে পরিবারের সদস্যরা বসবাস করে। তবে এরমধ্যে একটি ঘরে এক বয়স্ক লোক বাস করেন।
ঘটনার দিন মরিয়ম সময় মত বাড়িতে না ফেরায়, ওই ৪/৫টি বাড়ির আশেপাশে সহ পরিত্যক্ত বসতঘর এবং রাস্তার চারপাশের ঘটনার দিন বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মরিয়ম কে খুঁজেছিল তার পরিবারের সদস্যরা।
তবে ঘটনার দিন বসতঘরের মধ্যে ঘটনার দিন হয়নি মরিয়মকে। নির্জন রাস্তায় কালাম সরদার ঘর উত্তোলনের পরই মাদক সেবনের আড্ডা পূর্বের তুলনায় আরো জমজমাট হয়ে উঠে।
এই কালাম সরদারের বিশ্বস্ত সহোযোগী হলেন- শাহিন ও হালিম। নির্জন রাস্তা ও বাগান সহ কালাম সরদারের ঘরে ইয়াবা-গাজা সেবন করেন একই গ্রামের মঞ্জু খানের ছেলে মো. রাজিব (২৫), মকবুল খানের ছেলে মুজাহিদ (২৫), মৃত. আজিদ হাওলাদারের ছেলে মিরাজ (২২), আনি হাওলাদারের ছেলে খালেক (২৫), সাইদুল খানের ছেলে রাকিব (১৯) ও নূরুল ইসলামের ছেলে জাহিদ (১৯)।
একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করে বলছে- রাজিব (২৫) কে আটক করলে পুরো ঘটনার ক্লু বেড়িয়ে আসবে।
স্কুলছাত্রী মরিয়ম নিখোঁজ হওয়ার পর এবং মরিয়মের মরদেহ উদ্ধারের পর উপরোক্ত ব্যক্তিরাই গ্রাম ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
এরা কেউই সুনির্দিষ্টভাবে কোনোন কর্মে জড়িত নেই। সরেজমিন পরিদর্শনকালে নাম প্রকাশ না করা শর্তে অনেকেই বলেছেন- আত্মগোপনে চলে যাওয়া নেশাগ্রস্তদের আটক করে এলাকা ছাড়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলেই বেড়িয়ে আসবে মরিয়ম হত্যার মূল রহস্য।
সূত্রটি আরো নিশ্চিত করে বলেন- ঘটনার দিন পরীক্ষার পরই মরিয়ম স্কুল থেকে রওনা হওয়ার পর পরই থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু হয়। তখন মরিয়ম স্কুলের পেছনে বন্ধ থাকা সত্তার সরদারের মূল রহস্য সামনে একা অবস্থান নেই।
কাছ থেকেই দৃশ্যটি দেখেছেন- একই গ্রামের রুবেল নামের এক যুবক, তখন তিনি পুলের ওপার (মরিয়মের যাবার পথে) দুই যুবককে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন।
এলাকায় লোকমুখে প্রথমে এ তথ্য ছড়িয়ে পড়লেও পরবর্তীতে রুবেল তার দেখা চোখের বিষয়গুলো অস্বীকার করতে শুরু করে বলে জানা যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুই মাস পূর্বে স্থানীয় সাবেক মেম্বার রাজ্জাক খানের বাড়ির সামনে থেকে ভংগা আজিমপুর খেয়াঘাট পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগে নেয় এলাকাবাসি।
কবিরের বাড়ির সামনে থেকেই বয়ে গেছে এ রাস্তা। কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ৫ জন। তারমধ্যে একজন মরিয়মের বাবা কবির।
রাস্তার পাশ থেকে মাটি কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এই মাটি কাট নিয়ে জয়নগর ইউনিয়নের চরসোনাপুর গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে হোসেনের রত্তন হোসেনের খান এবং একই ইউনিয়নের পূর্ব ভংগা গ্রামের মৃত. মোকলেছুর রহমানের ছেলে মো. বজলু হোসেনের (৪২) সাথে কবিরের দ্বন্দ্ব হয়।
বজলুর কিছু জমি রাস্তায় চলে যায়। যে কারণে বজলু আর কবিবের মধ্যে শত্রু হয়ে যায়।
রত্তনের জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তায় দেয়ার গালাগালি করে। যার প্রতিবাদ করায় কবিরকে বেদম মারধর করে রত্তন। আহত কবির মুলাদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক সপ্তাহ ভর্তি ছিলেন। বজলুর বাড়ির সামনে থেকেই মরিয়মের স্কুলে আসা-যাওয়ার পথ।
বজলুর বাড়িতে থাকে তার বয়স্ক মা। ঘরের একটি কক্ষে বজলু অন্য কক্ষে থাকে তার মা। আর পরিত্যক্ত রয়েছে আলাদা একটি ঘর।
বজলুর ৩য় স্ত্রী থাকেন ঢাকায়। মাস কয়েক আগে বজলু তার তালাকপ্রাপ্ত ২য় স্ত্রীকে বসত ঘরে এনে রাত্রিযাপন কালে হাতেনাতে এলাকাবাসী ধরে ফেলে। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। চরিত্রগত সমস্যা রয়েছে বজলুর।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেন্দিগঞ্জ থানার এসআই রাত্রিযাপন চাকলাদার বলেন, মরিয়মের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে- এখন পর্যন্ত কালাম সরদার ও শাহিন নামের দুইজনকে আটক করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আসামি শনাক্ত করণের চেষ্টা চলমান রয়েছে। অতি শীঘ্রই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে। পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে মরিয়মের মরদেহের ময়না তদন্তের জন্য বরিশাল শেরে-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের মর্গে প্রেরণ করেছেন।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলেই সেই অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মৃত. মরিয়মের বাবা কবির হাওলাদার বলেন, পেশায় আমি একজন কাঠমিস্ত্রি। বাজে আড্ডা দেই না এবং রাজনীতি করি না।
দিন আনি দিন খাই। তাই পরিশ্রম করতে করতেই দিন চলে যায়। আমার মেয়েকে কে হত্যা করছে তাও আমি জানি না। তবে থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছি।
মৃত. মরিয়মের মা তাসলিমা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গ্যারান্টি দিয়ে বলেন, তার মেয়ের সাথে কোন ছেলের সম্পর্ক তো দূরের কথা, ছেলেদের সাথেই কথাও বলতো না।
মেয়ের বাবা স্কুলে এগিয়ে দিয়ে আসার সময় এক প্যাকেট চিপস কিনে দিয়েছিলেন। সেই চিপস তার ব্যাগে লাশের সাথে পাওয়া গেছে। তার ৪ মেয়ে ১ ছেলে। বড় ও মোজো মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। আর দুই মেয়ে মরিয়ম ও জামিলা।
৫র্থ শ্রেণীতে পড়ে জামিলা। ছোট মেয়ের শরীরে প্রচণ্ড জ্বর থাকায় মরিয়ম নিখোঁজের দিন স্কুলে যায়নি।
পূর্ব কাদিরাবাদ বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন- মরিয়ম প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতো না। সে নম্র ভদ্র মেয়ে ছিল।
স্কুল জীবনে বাহিরের কোন ছেলের সাথে কথা বলতেও দেখেননি। মরিয়ম হ/ত্যার বিচারের দাবিতে উপজেলার নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে মানববন্ধন।