শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৭ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেক্স :ভালোবেসে গানের মানুষেরা ডাকতেন ‘এবি’ বলে। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের এনায়েত বাজারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আজ (১৬ আগস্ট) তার ৫৮তম জন্মদিন। কিন্তু তিনি আজ নেই। অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীকে কাঁদিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর না ফেরার দেশে চলে যান ব্যান্ডসংগীতের উজ্জ্বল এই নক্ষত্র।
কিন্তু নেই হয়েও তিনি আছেন। তিনি থাকবেন। কারণ, তিনি আইয়ুব বাচ্চু। দেশীয় ব্যান্ড সংগীতের মধ্যমণি। সুরে-গানে-সংগীতে তিনি বেঁচে থাকবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার জন্মদিনে ভক্ত-অনুরাগী ও সংগীত প্রেমিদের শ্রদ্ধা, ভক্তি আর ভালোবাসা সেই ঈঙ্গিতই স্পষ্ট করে। মানে, আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
“আইয়ুব বাচ্চু” আইয়ুব বাচ্চুর পরিবারের কেউ গানের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ছিল সুতীব্র প্রেম-ভালোবাসা। আধুনিক-লোকগীতি-ক্লাসিক্যালের পাশাপাশি শুনতেন প্রচুর ওয়েস্টার্ন গান।
এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলতেন, প্রচুর গান শোনতাম। নিজেও একসময় গাইতে চেষ্টা করলাম। স্কুলে পড়াকালীন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। আর তখন থেকেই ওয়েস্টার্ন মিউজিক ভালো লাগত। শুরু করি গিটার চর্চা। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুর হয়ে উঠেন আমার অনুপ্রেরণার উৎস। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে একটা ব্যান্ডদল গড়ি। প্রথমে ব্যান্ডের নাম রাখা হয় ‘গোল্ডেন বয়েজ’, পরে নাম পাল্টিয়ে রাখা হলো ‘আগলি বয়েজ’। বিয়েবাড়ি, জন্মদিন আর ছোটখাট নানা অনুষ্ঠানে আমরা এই ব্যান্ডদল নিয়ে গান করতাম।
স্কুল-কলেজের ছেলেমানুষি ভুলে বন্ধুরা যে যার মতো একেক দিকে ছড়িয়ে পড়লেও আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক নিয়েই থাকলেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে ‘ফিলিংস’ নামের একটি ব্যান্ড তখন গান করতো। ফিলিংসের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চু জড়িত ছিলেন কিছুদিন। ১৯৮০ সালে যোগ দেন ‘সোলস’ ব্যান্ডে। সোলসের লিডগিটার বাজানোর দায়িত্বে ছিলেন টানা ১০ বছর। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল গড়ে তুললেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি।
জীবদ্দশায় এলআরবি গঠন সম্পর্কে এবি জানান, আসলে মিউজিক নিয়ে নতুন কিছু এক্সিপেরিমেন্ট করার ভাবনা থেকেই এলআরবির জন্ম। হার্ড-রক ছিল আমাদের প্রথম পছন্দ। এলআরবি দিয়ে শুরুতে বোঝানো হয়েছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। কিন্তু কিছুদিন পর এক প্রবাসী বন্ধু জানান, এই নামে অস্ট্রেলিয়ায় একটি ব্যান্ড আছে। তাই প্রয়োজন হয় দলের নাম পাল্টাবার। অতঃপর এলআরবি আদ্যাক্ষর ঠিক রেখে ব্যান্ডের নতুন নাম রাখা হলো ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’।
অডিও মাধ্যমের চেয়েও এলআরবিকে বেশি সরব দেখা গেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কনসার্টে। যে কোনো স্টেজ শোতে অংশ নেওয়ার আগে আইয়ুব বাচ্চু পুরো দল নিয়ে প্র্যাকটিস করতে কখনও ভুল করতেন না। সারা দিন সময় না পেলে মধ্যরাতে হলেও তিনি প্র্যাকটিস করতেন। ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশের কনসার্টে এলআরবি পারফর্ম করেছে। অংশ নিয়েছে প্রায় ২ হাজারের মতো কনসার্টে।
আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে অধিক জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট’, ‘নীল বেদনা’, ‘আসলে কেউ সুখী নয়’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘সেই রুপালী গিটার ফেলে’, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ফেরারী মন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবির অ্যালবামসমূহ-
একক: রক্তগোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৬), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৯), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কী (২০০০), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির গানে মাটির টানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স-ইন্সট্রুমেন্টাল (২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮) ও বলিনি কখনও (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫)।
ব্যান্ড: এলআরবি ১ ও ২ (১৯৯২), সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০১), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নাই (২০০৫), লাইভ অ্যালবাম ফেরারি মন (আন প্লাগড ১৯৯৬), স্পর্শ (২০০৮)।
অসংখ্য জনপ্রিয় অ্যালবাম ও গানের তারকা আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন ভীষণ অভিমানীও। ভেতরে ভেতরে কষ্ট-অভিমান পুষে রাখতেন। গিটারের ঝংকারে সেই অভিমান-কষ্ট ছড়িয়ে দিতেন শিশুর মতো কেঁদে কেঁদে- তার দীর্ঘদিনের সঙ্গীরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এ কথা সাবলীলভাবেই বলেছেন।
আইয়ুব বাচ্চু’র বাবার নাম মোহাম্মদ ইসহাক ও মায়ের নাম নূরজাহান বেগম। সংসার জীবনে তিনি স্ত্রী, ফাইরুজ সাফরা নামে এক কন্যা ও তাজোয়ার নামে এক পুত্র সন্তান রেখে গেছেন।
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর মাত্র ৫৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেশীয় ব্যান্ডসংগীতের অন্যতম দিকপাল, গিটার জাদুকর ও এলআরবি’র প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চু। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম নগরীর প্রবর্তক মোড়ে স্থাপন করা হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার। মোড়টির নামকরণ করা হয়েছে ‘আইয়ুব বাচ্চু চত্বর’।