শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১২ অপরাহ্ন
রাজধানীর বাড্ডার নামাপাড়া এলাকার গৃহশ্রমিক রাশিদার দুই ছেলে। বড়টি ১৪ বছরের, ছোটটি সাত বছরের। স্কুলে যেতে দিচ্ছেন না একজনকেও। বাচ্চা দুটি ভয়ে ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। তাদের রিকশা শ্রমিক বাবাকেও ঘরের বাইরে যেতে দিচ্ছে না।
শিশু দুটির ভয়, তারা একা থাকলেই হত্যা করা হবে। আর বাবা-মাও তাদের ভীতিটা উপেক্ষা করতে পারছেন না। কারণ, তাদের মধ্যেও ছড়িয়েছে এই বিশ্বাস যে, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করে মাথা নিয়ে যাবে পদ্মা সেতুর জন্য।
রাশিদা কাজ করেন উত্তর বাড্ডায় ইভা দাসের বাসায়। আর গৃহকর্তার কাছে তিনি তার উদ্বেগের কথা খুলে বলেন। জিজ্ঞেস করেন ‘আফা, দুই দিন রাইতে নাকি কারেন (বিদ্যুৎ) থাকত না। সেই দিন বাচ্চাগো নাকি ধইরা নিয়া যাইব?’
এমন প্রশ্ন শুনে ইভার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। বুঝতে পারে, পদ্মা সেতু নিয়ে ছড়ানো এটি নতুন গুজব। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন রাশিদা। কিন্তু বিশ্বাস করাতে পেরেছেন কি না, সন্দিহান।
ঢাকা টাইমসকে ইভা বলেন, ‘আমি বললাম, এগুলো সব বাজে কথা। কিন্তু সে বুঝেছে বলে মনে হলো না। আমার কথায় আস্থা রাখতে পারছে না। আবার কোত্থেকে এসব কথা জেনেছে, সেটাও সুনির্দিষ্ট বলতে পারে না। বলে, বস্তির সবাই জানে।’
গত কিছুদিন ধরে ফেসবুক ও ইউটিউবে পদ্মা ছড়ানো হচ্ছে উদ্ভট কথা। পদ্মা সেতু নির্মাণে এক লাখ মানুষের মাথা লাগবে এবং তা সংগ্রহে সারা দেশে ৪২টি দল কাজ করছে। আর তারা প্রধানত শিশুদের মাথা কেটে নিতে আসছে। গুজব এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে, সেতু কর্তৃপক্ষকে বিবৃতি দিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে হয়।
তবু থামছিল না কিছু। আর র্যাব ও পুলিশ অভিযানে নামে। গ্রেপ্তার করা হয় ২৩ জনের বেশি মানুষকে, যারা গুজব ছড়াচ্ছিল। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার নেত্রকোণায় একটি শিশুকে মাথা কেটে হত্যা করা হয়। সারা বছরই নানা সময় এই ধরনের হত্যার খবর আসে গণমাধ্যমে। কিন্তু গুজবের মধ্যে এই হত্যার ধরণ গুজবকে আরও উস্কে দেয়। তৈরি হয় আতঙ্ক। আর ছেলেধরা সন্দেহে চলতে থাকে একের পর এক গণপিটুনি।
এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ জনকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার খবর এসেছে গণমাধ্যমে, যার তিনটি ঘটেছে ঢাকায়। নারায়ণগঞ্জে নিজের মেয়েকে দেখতে যাওয়া বাক প্রতিবন্ধী যুবককে হত্যা করা হয়েছে, তিনি প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন না বলে। লালমনিরহাটে মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধাকে পেটানো হয়েছে তার পিঠে ব্যাগ দেখে। গুজব এবং গণপিটুনি ঠেকাতে সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে পুলিশকে দেওয়া হয়েছে কড়া নির্দেশনা।
এর মধ্যে নতুন গুজবে রাশিদার মতো মানুষদের মধ্যে নতুন উদ্বেগ ছড়াচ্ছে মুখ থেকে মুখে। ফেসবুকেও চলছে অপপ্রচার। সবই যে উদ্দেশ্যহীন তা নয়, ইংরেজি লিখতে পারেন, এমন ব্যক্তিরাও ইনবক্সে পাঠাচ্ছেন এসব বার্তা। একজন ম্যাসেজ পাঠানোর পর ‘এসব কী পাঠান?’-পাল্টা ম্যাসেজের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওকে দ্যান ইগনোর ইট (ঠিক আছে, তাহলে পাত্তা দিয়েন না)’।
তবে নতুন এই গুজবের বিষয়টি এখনো জানে না পুলিশ। বাহিনীটির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশন ইউনিটের উপকমিশনার আলীমুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আজ সকালেও অফিসারদেরকে ডেকে বলেছি। কিন্তু এমন গুজব ছড়ানোর বিষয়টি এখনো আমাদের নজরে আসেনি। তবে আগে গুজব ছড়ানোর কিছু সাইট ও আইডি ব্লক করেছি। তার সবগুলোই ঢাকার বাইরে। আমরা এখন মূল হোতাদেরকে শনাক্ত করে ধরার চেষ্টা করছি। আর নতুন কিছু পেলেও আমরা ব্যবস্থা নেব।’
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গুজব ছড়ানোর দায়ে সারা দেশ থেকে ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের ধরতে এখনও অভিযান অব্যাহত আছে।’
এই গুজবের কারণে নি¤œ আয়ের মানুষরা বসবাস করেন, বিশেষত এমন এলাকায় স্কুলে উপস্থিতি কমে যাওয়ার খবর মিলেছে। এই স্কুলগুলো প্রধানত নগরীর উপকণ্ঠে অবস্থিত।
রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার বাসিন্দা এক নারী তার দুই সন্তানকে স্কুলে দিচ্ছেন না গুজব আতঙ্কে। কেন এই সিদ্ধান্ত? ওই নারী বলেন, ‘আমার ছেলে, মেয়ে গেলে তো আর ফেরত আসবে না।’
মতিঝিল মডেল স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ শফি বলেন, ‘অনেক অভিভাবক আমাদের কাছে জানতে চান কতজন বাচ্চা এ পর্যন্ত নিখোঁজ হয়েছে? এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। এর মানে অভিভাবকরা অনেক বেশি আতঙ্কগ্রস্ত।’
উপায় কী?
এই গুজব ঠেকানোর উপায় কী- এমন প্রশ্ন নিয়ে ঢাকা টাইমস কথা বলেছে দুই জন গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। তারা দুই জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক। দুইজনই বলেছেন, কোনো একটি একক ঘটনা নয়, শৈশব থেকেই শিশুদেরকে মানবিক হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
এই মুহূর্তে জনপ্রতিনিধি শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ অপিনিয়ন লিডারদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে জনগণের কাছে এই বিষয়টি নিয়ে যেতে হবে। তাদেরকে বলতে হবে এগুলো শুধুই অপপ্রচার।’
‘মসজিদের ইমামদের কাজে লাগানো যেতে পারে। তাদের কথা এলাকার সবাই শোনেন। তারা যদি বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে, তাহলে সুফল মিলবে। স্কুলে স্কুলেও শিক্ষকদেরকে প্রতিনিয়ত আলোচনা করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে কোনো কিছু শুনলেই তাৎক্ষণিক উত্তেজিত হওয়া যাবে না। এটা পারিবারিক চর্চার মধ্যেও আনতে হবে।’
একই বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গুজব ঠেকাতে গণমাধ্যমের যে ভূমিকা থাকা দরকার ছিল, সেটা নেই। যদি করতো তাহলে এই ধরনের হত্যা ঘটত না।’
‘পরিবারের বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় উপসানালয়ে এসব শেখাতে পারে। মায়া, মমতা সূক্ষানুভূতিগুলো তৈরি করতে পারে। কিন্তু কেউ এসব করছে না। না পরিবার, না শিক্ষক। কেউ আর বই পড়ে না, বই না পড়লে একটি ভালো প্রজন্ম আসবে কোথা থেকে? তাহলে এই জাতি শিক্ষিত হবে কী করে? আমরা বর্বরতায় ডুবে যাচ্ছি।’
সমাজকে পুরোপুরি পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া উপায় নেই বলেও মনে করেন অধ্যাপক জুনাইদ। বলেন, ‘একটা জাতি কত উগ্র আর আক্রমণাত্মক হলে একজন নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে হত্যা করতে পারে! এমন একটা প্রজন্ম আমাদের সামনে বড় হয়ে উঠছে, যাদের কোনো বিচার বিবেচনা নেই। সংবেদনশীলতা নেই। এই সংবেদশীলতাতো গণমাধ্যমেরই তৈরি করে দেওয়া কথা। কিন্তু কোনো একটি টেলিভিশন দায়িত্বশীল কোনো অনুষ্ঠান তৈরি করার চেষ্টা করেন না। তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখবে কোথা থেকে? বরং বাজে আর উগ্র ভাষা ব্যবহার কারে নাটক তৈরি করে তাদেরকে উগ্রতার শিক্ষা দিচ্ছে।’