বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০২:০৩ পূর্বাহ্ন
এস এল টি তুহিন: গাঢ় সবুজ প্রকৃতি, নীল শুভ্র আকাশ এর ঠিকানা ছিলো বরিশাল। পাম, দেবদারু আর লাল সুড়কী বিছানো দু’পাশে ঝাউয়ের সারি এক অপরূপ সৌন্দর্যের কথাই দেশময় প্রচার করতো। তবে এসব সৌন্দর্যের কেন্দ্রেই ছিলো ছন্দময় প্রবাহমান আঁকা বাকা খাল। এক কথায় ‘বাংলার ভেনিস’। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের এমন উপমা’র কবিতায় রূপ দিতেই এ শহরে একদিন জন্মেছিলেন জীবনানন্দ দাশ বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ আমি খুঁজিতে যাই না আর’। ২২ খাল আর এমন অপরূপ সৌন্দর্যের প্রাচীন শহর নিয়ে প্রবাদতুল্য কথাও কম নেই। কেউ কেউ বলেন- বরিশালের এমন প্রকৃতি আর ছন্দময় নির্মল বাতাস না-কি বিমান প্রশিক্ষনের জন্যে প্রসিদ্ধ। আবার উপকুলের কাছের শহর হবার কারনে ঝড়-বন্যায়ও বরিশাল না-কি নিরাপদ। বলা হতো দেশ বন্যায় ডুবে গেলেও বরিশাল কখনো বন্যার পানিতে ডুবে যাবে না।
এসব কথার মূলেই ছিলো বরিশালের প্রাণ ২২ খাল। তবে দিন বদলে গেছে। দু’শো বছরের বেশী পুরনো বরিশাল শহর গড়ে উঠেছিলো মাত্র আড়াই বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে। বগুড়া, আলেকান্দা, আমানতগঞ্জ এবং কাউনিয়া এ চার মৌজা নিয়েই ছিলো বরিশাল শহর। সেসময় এর লোক সংখ্যা ছিলো ৬ হাজার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সময়কালে তৎকালীন জেলা নাম বাকেরগঞ্জের প্রশাসনিক দপ্তর নলছিটির বাড়ই করন থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি: উইন্টাল ১৮০১ সালে কীর্তনখোলা নদী তীরে বাধ দিয়ে গড়ে তোলেন বরিশাল শহর। কীর্তনখোলা নদী আর বরিশাল অবিচ্ছেদ্য ধারা। ২২ খালের উৎস কিন্তু কীর্তনখোলা নদী। যেমন জেলখাল, সাগরদী খাল, আমনতগঞ্জ খাল, ভাটার খাল, রায়ের খাল, নাপিতখালী খাল অন্যতম। এ খালগুলোর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। জীবন ও প্রকৃতিকে এগিয়ে নেয়া এবং প্রাণ বৈচিত্র্যকে সংরক্ষনে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখছিলো এসব খাল। নগরীর ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, খালগুলোকে ঘিরেই এখানকার সভ্যতার গোড়া পত্তন হয়েছিলো। যেমন জেল খালের উদাহরন দিয়েই বলি- ৫.২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল। পূর্বে কীর্তনখোলা নদী থেকে শুরু হয়েছে। মিশেছে সন্ধ্যা নদীতে।
কীর্তনখোলা মোহনায় খালের পাশে দুশো বছরের প্রাচীন হাটখোলা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক কেন্দ্র। যতই পশ্চিমে যাবেন দেখা মিলবে নানা স্থাপনা ও বসতি। প্রবাহমান ধারার পাশেই রয়েছে প্রাচীন কালের বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার। এর কারনেই নাম জেল খাল। বরিশাল শহরের সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন কাঁচা বাজার। বরিশালের প্রথম বৃহৎ চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র অর্থাৎ জেনারেল হাসপাতাল, ঝালকাঠীর বিখ্যাত বাসন্ডার জমিদারের বাসভবন, জেলে সম্প্রদায়ের বাস, আদি মহাশশ্মান ঘাট, স্বাধীনতা পূর্বকালে গড়ে ওঠা বিসিক শিল্প নগরী।
এগুলো সবই বহমান সভ্যতার সমৃদ্ধ ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করছে। দু’পাড়ের মানুষের দৈনিন্দন জীবনের নানা প্রয়োজনের পানির চাহিদা মেটাতো এই খাল। ছোট ছোট যাত্রীবাহী লঞ্চ যাকে এক সময় স্থানীয়রা বলতো ‘টেডি লঞ্চ’ তা নাজিরের পোল থেকে ছেড়ে যেতো বানারীপাড়া ও রহমতপুরের দিকে। মাধবপাশা ও লাকুটিয়ার জমিদার পরিবারের সদস্যরা এসব খাল যোগাযোগের পথ হিসাবে ব্যবহার করতেন।
পূর্বের কীর্তনখোলা ও উত্তর, পশ্চিমে আড়িয়াল এবং সন্ধ্যা নদীতে তারা পৌছেন নৌকায়।যদি ঐতিহ্যের কথা বলে হয়- তা হলে দু’টি ঘটনা উল্লেখ করতে হয়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কয়েকবার বরিশালে আসেন। ১৯০৫ সালে আসেন তার নিজ বজরায় চেপে। ১৫ আগস্ট দুপুরে তিনি এসে পৌঁছান। উদ্দেশ্য একবার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এক সভায় অংশগ্রহন ও সভাপতিত্ব করা। প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন নিয়ে পুলিশের সাথে সংঘাত ও উত্তেজনা চলছিলো। কবি বজরাতেই ভাটার খালে অবস্থান করেন। সাহিত্য পরিষদ নেতৃবৃন্দ রাতে বজরাতে কবির সাথে সাক্ষাত করতে যান।
১৯২০ সালে জাতীয় কবি নজরুল বরিশালে আসেন। শহরের রূপ দেখে মুগ্ধ হন এবং ভেনিস শহরের সৌন্দর্য খুঁজে পান। সেই থেকে বরিশালের নাম দেন ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ বা বাংলার ভেনিস।বরিশালের খালগুলোর আরেকটি প্রাচীন অর্থনৈতিক এবং যোগাযোগের গুরুত্বের কথা পাওয়া যায় তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বেভারেজ এর ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ বইয়ে। উল্লেখ করেছেন- শহরের মধ্যের খালগুলোতে যে খেয়া নৌকায় মানুষ পারাপার হতো সেখান থেকে মাসিক রাজস্ব আসতো ৬ শত টাকা। এসব থেকে মনেই হচ্ছে- বরিশাল শহর কখনো জলে ডুবতো না। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ভেনিস শহরের সেই খাল সহসা খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কোথাও কোথাও পাওয়া গেলেও জোয়ার ভাটার প্রবাহ নেই। সংকীর্ন ক্ষীনধারা রয়েছে।
এসব খাল বন্যা ও বর্ষার পানি ধরে রাখতে পারছেনা। শহরের প্রবীন অধিবাসীদের মতে, দেশ স্বাধীনের পরবর্তীকাল থেকেই এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৯২ সালে বরিশাল প্রশাসনিক বিভাগে উন্নীত হওয়ার পর থেকে খালগুলোর বৈশিষ্ট্য লোপ পেতে থাকে। পরবর্তীকালে বরিশাল পৌরসভা বরিশাল সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলে ‘শহরের প্রাণ’ খালগুলোর অস্তিত্ব সংকট দেখা দেয়।এর মূল কারনই হচ্ছে- অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন। এতে চাপে পড়ে যায় খালগুলো। কোথাও ভরাট হয়েছে, কোথাও খালের জমি দখল করে স্থাপনা হয়েছে। এ কারনে নগরী তার প্রাকৃতিক রূপ-সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। ঐতিহ্য হারাতে বসেছি আমরা। প্রভাব পড়ছে জলজ প্রাণ বৈচিত্র্য সংরক্ষন ও গোটা জীবনধারায়।
বর্ষা এলে জল নিষ্কাশনে সমস্যা দেখা দেয়। জলাবদ্ধতায় ডুবে যায় প্রাণ বৈচিত্র্যের শহর বরিশাল। গত কয়েক বছর ধরে দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া বরিশালের খালগুলো উদ্ধারে চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার ও নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সুফল খুব বেশী পাওয়া যাচ্ছেনা। এবার নগরীর ৫টি খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি টাকা।
আগামী ১৪ এপ্রিল টেন্ডার বাক্স খোলা হবে। প্রক্রিয়া শেষে খনন শুরু হতে পারে এমাসের শেষে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন- আইনী কাঠামোর মধ্যে না এনে খালগুলো সংস্কার ও দখলমুক্ত করে উন্নয়ন করা হলে তা টেকসই হবে না। সবই করতে হবে আইনী কাঠামোর আওতায়। তা হলে খালগুলোতে প্রাণ-বৈচিত্র্য ফিরে আসতে পারে। হতে পারে যুগোপযোগী টেকসই উন্নয়ন। জোয়ার-ভাটার প্রবাহে জলের যে কলরব আসবে তাতেই প্রাণ ফিরে পেতে পারে খালগুলো।