শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৫ পূর্বাহ্ন
বরিশাল: নদী ভাঙন কবলিত বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী উজ্জ্বল দাস । তিনি উপজেলার শ্রীপুর বাজারের এক সময় প্রতাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন।
তবে নদী ভাঙনের কারণে শ্রীপুর বাজার বিলীন হয়ে যাওয়ায় উপজেলার বাহেরচর বাজারে দোকান দিয়েছেন। গ্রামের বাজারের দোকানে চা-পানের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট, চানাচুর, কোমলপানীয়ও বিক্রি করেন তিনি। এ দোকানের আয়ের ওপর ভরসা করেই চলছে উজ্জ্বলের সংসার। বিগত কয়েক বছরে নদী ভাঙনের কারণেই উজ্জ্বল দেনা হয়েছেন প্রায় ৫ লাখ টাকা।
আর এ পাঁচ লাখ টাকার দেনা নদীর ভাঙনের কারণে বসতঘর ও দোকান বারবার সরিয়ে অন্যত্র পুনঃনির্মাণ করতে গিয়েই হয়েছেন বলেও জানান উজ্জ্বল দাস।
তিনি বলেন, প্রতিবার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না করতে নতুন করে নদী ভাঙনের শিকার হয়েছি। আর এভাবেই পুরাতন ঋণ পরিশোধের আগে নতুন করে ঋণে জড়িয়েছি। আর ঋণ করে দোকানঘর না চালালে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হতো। কারণ সম্পদ বলতে যেটুকু জমি ছিলো তার সবই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
বছর পাঁচেক আগেও শ্রীপুর বাজার থেকে নদী প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ছিলো বলে জানিয়ে বাহেরচর বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক বলেন, গতকয়েক বছরের ভাঙনে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসহ বহু স্থাপনা এবং বাজার বিলীন হয়েই গেছে। সেই সঙ্গে শ্রীপুর গ্রামটিও নেই বললেই চলে। এখন ঘনবসতিপূর্ণ শ্রীপুর গ্রামের আধা কিলোমিটার জায়গা হয়তো রয়েছে নদী গর্ভে বিলীনের অপেক্ষায়। সেই জায়গার ওপর কয়েকটি বসতঘর ও আদি শ্রীপুর বাজারের গোটা কয়েক দোকানঘর রয়েছে।
তিনি বলেন, নদী ভাঙনের কারণে শ্রীপুর বাজারের প্রায় তিন শত ব্যবসায়ী আজ আলাদা হয়ে গেছে। একদল শ্রীপুর গ্রামে টিকে থাকা অংশে অর্থাৎ ২ নম্বর ওয়ার্ডের শেষাংশ ধরে এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু অংশ মিলিয়ে দোকানঘর তুলেছেন। আর বাকিরা ৫ নম্বর ওয়ার্ড অর্থাৎ বাহেরচর বাজারে এসে দোকানঘর তুলেছেন।
তিনি আরও বলেন, একইভাবে ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দারাও যে যেখানে পেরেছেন সেখানে গিয়ে নতুন বসতি গড়েছেন। এমনকি দোকান ও বসতঘর নতুন করতে তুলতে গিয়ে ব্যবসায়ীসহ গ্রামের অনেক বাসিন্দাই ঋণগ্রস্ত হয়েছেন।
মাছ ব্যবসায়ী হান্নান বলেন, একদিকে সংসার চালানো, অন্যদিকে দোকান ও বসতঘর নদীর হাত থেকে রক্ষা করে নতুন জায়গাতে নিয়ে পুনঃনির্মাণের খরচ চালানোর একমাত্র অবলম্বন বাজারের দোকান। বিকল্প কোনো জমি না থাকায় এবং পরিবারের কারো কর্মসংস্থানের সুযোগ এখনও না হওয়ায় ঋণ করেও দোকান সচল রাখতে হচ্ছে। কারণ এটা পরিবারের সবার চালিকা শক্তি।
শ্রীপুর বাজারের ব্যবসায়ী মালেক খান জানান, একসময় নিজের ভিটেতেই দোকান ছিলো তার, গত পাঁচ থেকে সাত বছরে ১০ বারের ওপরে দোকানঘর তাকে সরাতে হয়েছে। এখন অন্যের ভিটে বাৎসরিক খাজনায় নিয়ে দোকানঘর তুলেছেন। দোকান যতবার নদীর কাছে আসে ততবার ভেঙে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে আনা এবং খাজনায় জমি নিয়ে পুনঃনির্মাণ করতে কারো ৫০ হাজার আবার কারো এক লাখ টাকা খরচ হয়।
তিনি বলেন, চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে দোকানঘর নতুন করে যেখানে বসিয়েছি, অব্যাহত ভাঙনে নদী বর্তমানে দোকানঘর কাছাকাছি চলে এসেছেন। এবার দোকান সরাতে হলে নতুন করে ঋণ করতে হবে। কিন্তু স্থানীয় ব্যাংক বা সমিতি থেকে নেওয়া আগের ঋণের টাকাই পরিশোধ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, শুধু দোকানঘর নয়, বসতভিটের জমিও ভাঙনের মুখে। যেকোনো সময় সেখানেও বড় বিপদ ঘটতে পারে। সেই ঘর খুলেও নতুন জায়গাতে নিয়ে যেতে হবে দ্রুত।
এদিকে সহায়-সম্পদ সব হারিয়ে এখন পরের জমিতে কোনোভাবে ঘরতুলে আশ্রয় নেওয়া জাহিদুল জানান, বছরের পর বছর বিশেষ করে ২০১২ সালের পর থেকে এ নদী শ্রীপুরের ওপর আগ্রাসী। প্রতিনিয়ত গিলে খাচ্ছে শ্রীপুরকে। জনপ্রতিনিধিসহ অনেকেই আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু কেউ ভাঙনরোধ করতে পারেনি। আমিসহ গ্রামের শত শত মানুষ ও পরিবারের সহায়-সম্পদ সবকিছু কালাবদর নদীর গর্ভে। আর নিজেদের জীবন টিকিয়ে রাখতে এখন দেনায় জর্জরিত ওইসব মানুষ। কারণ এখানে বেশিরভাগ মানুষই মৎস্য ও কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তিনি জানান, যাদের অর্থ ছিলো তাদের অনেকেই গ্রাম ছেড়েছে, আর যারা অর্থসংকটে ও ঋণে জর্জরিত ছিলেন তারা পেশা ছেড়েছেন নয়তো ন্যুজ্ব হয়ে চলছেন।
মাস্টার্সের ছাত্র ও শ্রীপুরের বাসিন্দা নিজ্জল দাস জানান, তিনি তার বাবার দোকান সাত বার নদী ভাঙনের কারণে সরাতে দেখেছেন। সেসঙ্গে বসতভিটে এক বার সরাতে হয়েছে। বাবার ব্যবসার হাল বড়ভাই এখন ধরেছেন, আর এ ব্যবসা ছাড়া তাদের সাত জনের পরিবারের উপার্জনের কোনো মাধ্যম নেই।
উল্লেখ্য কালাবদর, তেঁতুলিয়া, গণেশপুরা নদী পরিবেস্টিত বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের অবস্থান। কালাবদরের অব্যাহত ভাঙনে সদর ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামটির প্রায় সবটুকুই বিলীন হয়ে গেছে। আধা কিলোমিটার জায়গা বাকি রয়েছে, তাও ভাঙনের মুখে প্রতিনিয়ত ছোট হয়ে আসছে।