শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ অপরাহ্ন
অবসান ঘটলো একটি অধ্যায়ের। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভোগার পর না ফেরার দেশে চলে গেলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি পদে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় নয় বছর সরকার চালানো এরশাদ আমৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এ পর্যায়ে জেনে নেওয়া যাক তার ‘বর্ণিল’ জীবনের সাতকাহন।
জন্ম, শিক্ষা ও সেনাবাহিনীতে যোগদান
এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মশহরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা গ্রহণের পর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন এরশাদ। তিনি ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের পর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং পরবর্তীতে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিয়োগ দেন তৎকালীন সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর মেজর জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে এলে এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে এরশাদ চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে আগ্রহ প্রকাশ হতে থাকে এরশাদের। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে উৎখাত করে এরশাদ সংবিধান রহিত করে সংসদ বাতিল করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে দায়িত্ব নেন।
এরপর এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। যদিও বিচারপতি চৌধুরীর কোনো প্রকার কর্তৃত্ব রাখেননি এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসনের পর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে এ পদেই বসে যান।
বিরোধী দলগুলোর বর্জনে নির্বাচন আয়োজন
এরপর ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন এরশাদ। নবগঠিত এ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন তিনি, মহাসচিব নিযুক্ত করেন অধ্যাপক এমএ মতিনকে। এরমধ্য দিয়ে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন এরশাদ। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্যে ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে এরশাদ তার জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এ পদে নির্বাচিত হওয়ার পর সে বছরের ১০ নভেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন আহবান করেন। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন পাশ করে সেদিন জাতীয় সংসদ সংবিধান পুনর্বহাল করে। তবে বিরোধী দলগুলোর প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর এরশাদ ফের সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। প্রধান বিরোধী দলগুলো ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনও বর্জন করে।
পতন ও কারাবন্দিত্ব
এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর অবিরাম আন্দোলন চলতে থাকে এবং প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এরপর ১৯৯১ সালে এরশাদ গ্রেপ্তার হন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে কারান্তরীণ অবস্থায় এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। তখনকার সরকার এরশাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতি মামলা করে। এর কোনো কোনোটিতে দোষী প্রমাণিত হয়ে তিনি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৯৬-এর সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ছয় বছর কারাভোগের পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন। তবে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়ার কারণে সংসদে তার আসন বাতিল হয়ে যায়। ২০০০ সালে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশই টিকে যায়।
নির্বাচন-জোট ঘিরে আলোচনার কেন্দ্রে
২০০১ সালের অক্টোবরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। এরপর তিনি ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর অনুষ্ঠিত দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন পেয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকেছে এরশাদের দলই।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে প্রায় সব নির্বাচনেই এরশাদ আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন। বিশেষ করে জোট গঠন, নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার প্রশ্নে, এমনকি জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ে পরিবর্তনে এরশাদের বক্তব্য ও অবস্থান বরাবরই সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।
‘পল্লীবন্ধু’ খেতাব
দেশজুড়ে উপজেলা স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য এরশাদ তৃণমূলে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। গ্রামমুখী উন্নয়নমূলক ভূমিকার কারণে এরশাদের অনুসারীরা তাকে ‘পল্লীবন্ধু’ খেতাবেও ভূষিত করেন।