বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:১৮ অপরাহ্ন
বছরের শুরুতেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) শিক্ষার্থী নির্যাতন ও হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে ক্যাম্পাসজুড়ে। অভিযোগ ওঠার পরপরই ছাত্রলীগ নেতা দাবিদাররা মিছিল ও সমাবেশ করছেন নির্যাতিতদের বিরুদ্ধে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে করা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কর্মসূচী নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি না থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগের নেতা দাবি করে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। জানা গেছে, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আলীম সালেহী নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে মূল অপকর্ম শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ ওঠে শিক্ষার্থী নির্যাতনের। কিছু ঘটনা জানাজানি হলেও বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। তাছাড়া হলগুলোতে দেশীয় ধারালো অস্ত্র মজুদের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ক্লিন ইমেজের লোক হিসেবে নিজেকে জাহির করলেও তার বিরুদ্ধে ইভটিজিংসহ নানা অপকর্মের অনেক শিক্ষার্থীরই অভিযোগ রয়েছে।
একই অভিযোগ রয়েছে ২০১৩-১৪ শিক্ষা বর্ষের গণিত বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন আহমেদ সিফাতের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ ক্যাম্পাসে সংঘর্ষের ঘটনার ইন্ধণদাতা হিসেবে রয়েছে তার নাম। কয়েকদিন পূর্বে তার দুই গ্রুপের মধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। কুপিয়ে জখম করা হয় বেশ কয়েকজনকে। তাছাড়া হলে রুম দখলসহ আধিপত্য বিস্তারে এগিয়ে রয়েছে এই নেতা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকা- নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুই ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করেই ক্ষান্ত থাকে।
বরিশাল জেলা ছাত্রলীগ জানিয়েছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোনো কমিটি নেই। সেখানে যারা ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দেন তারা কারা আমরা জানিনা।
জানা গেছে, ১০ মার্চ দুপুরেও ছাত্রলীগের কথিত নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতিতা ছাত্রী জান্নাতুল নওরীন ঊর্মির বিরুদ্ধে মিছিল করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে। আর সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা সিফাত। ১১ মার্চ ঊর্মিকে সমাবেশের মধ্যে দিয়ে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন ছাত্রলীগের নামধারী কর্মীরা। পাশাপাশি থানায় দেয়া অভিযোগে শিক্ষক সুজিত কুমার বালাকে প্রধান বিবাদী করায় নিন্দা বিবৃতি দিয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও। অপরদিকে ১১ মার্চ বিকালে বরিশাল জেলা ছাত্রদল নগরীতে বিক্ষোভ করেছে ঊর্মির উপর হামলার প্রতিবাদে। তাছাড়া ৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সামনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিভিন্ন গুজব, অপপ্রচার এবং শিক্ষকদের নামে মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন ছাত্রলীগের কথিত নেতাকর্মীরা।
সেখানে সেদিন নেতৃত্ব দেন আলীম সালেহী। তিনি নির্যাতিতা ছাত্রী ঊর্মির শাস্তিও দাবী করেন মানববন্ধনে। এদিকে ঊর্মিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের ঘটনায় বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর থানায় ৯ই মার্চ রাতে ৫ জনকে অভিযুক্ত করে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন উর্মির বাবা এ্যাডভোকেট মন্নান মৃধা। সেখানে গণিত বিভাগের শিক্ষক সুজিত কুমার বালা ও কথিত ছাত্রলীগ নেতা আলীম সালেহীসহ ৫জনকে বিবাদী করা হয়।
১ মার্চ বিকালে আলীম সালেহী সহ তার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কথিত নেতাকর্মী গনিত বিভাগের ৫ম ব্যাচের শিক্ষার্থী জান্নাতুল নওরীন উর্মির উপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। এসময় তাকে জ্যামিতি বক্সের কাটা কম্পাস দিয়ে আঘাত করা হয়। দুই দিন বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার পর তার শারীরিক অবস্থান অবনতি ঘটলে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে ঢাকায় হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
তবে এই বিষয়টি ধামাচাপা দিতে আলীম সালেহী ও মহিউদ্দিন সিফাতের নেতৃত্বে উল্টো নির্যাতিতার বিরুদ্ধেই বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করছে নামধারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই ছাত্রীকে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন শের-ই বাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের নারী সার্জারি ইউনিট-২ এর সহকারী রেজিষ্ট্রার ডাঃ মাহবুব আলম। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নির্যাতনের ঘটনা আরো ঘটেছে। ৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ রাফসান জানী প্রক্টরের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে তিনি গত ৫ মার্চ তাকে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেন একই বর্ষের ছাত্রলীগ নামধারী ৩ শিক্ষার্থী হাফিজুল ইসলাম, আব্দুল হাকিম সুমন ও হাসিব শেখ সাইমুনের বিরুদ্ধে।
নির্যাতনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী শীর্ষ নেতা গণিত বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মহিউদ্দিন আহমেদ সিফাতের অনুসারী উল্লেখ করে তাদের বিচার দাবি করেন লিখিত অভিযোগে। এর আগে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ শাহাজালাল গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই বাংলা হলের প্রভোস্ট বরাবর লিখিত আবেদন করে তাকে হত্যার হুমকি ও শারীরিক নির্যাতনের বিচার দাবি করেন। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই হলের ৪০১৬ নম্বর কক্ষ থেকে তাকে ডেকে ১০০১ নম্বর কক্ষে নিয়ে দরজা আটকে কোনো কারণ ছাড়াই তার ওপর নির্মম নির্যাতন করে। আবেদনে শান্ত, নওয়াব, রাদ ও সাঈফ নামের ৪ জন সহ বেশ কয়েকজন অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেন তিনি। এরা সবাই ছাত্রলীগ নামধারী শীর্ষ নেতা সিফাতের অনুসারী বলে জানিয়েছিলেন নির্যাতিত শাহাজালাল।
একই দিন বিকেলে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে ৪ জন শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে আহত করা হয়। তারা বেশ কয়েকদিন শের-ই বাংলা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এই হামলার সঙ্গেও ছাত্রলীগ পরিচয়ধারীরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে গত পহেলা মার্চ বিকেলে। ওই নির্যাতনের শিকার হন গণিত বিভাগের ৫ম ব্যাচের জান্নাতুল নওরীন উর্মি। তিনি দাবি করেন, মুখেশাধারী বেশ কয়েকজন তার ওপর হামলা চালায়। তাকে জ্যামিতি বক্সের সূচালো কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করা হয়। তার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গা সহ বিভিন্ন স্থানে কাটা দিয়ে ক্ষত করা হয়। সম্প্রতি নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে গেছেন ৩ শিক্ষার্থী।
ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ সিফাত বলেন, ছাত্রলীগের নাম খারাপ করার জন্য আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যে বিষয়টা সকলেই জানে। এই ষড়যন্ত্র বিগত দিনেও হয়েছে।
বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটি’র (সনাক) সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনক। এখনই এর বিরুদ্ধে কঠোর হস্তে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তা না হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে। এ সময় ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ধিক্কার জানান তিনি।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সুব্রত কুমার দাস বলেন, আমরা এসব বিষয় অবগত। ইতিমধ্যে দুই ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আমরা কারো রাজনৈতিক পরিচয় দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি না। আর সেটা আমাদের দেখার বিষয়ও না। আমরা সবগুলো বিষয়ই তদন্ত করছি এবং তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় জানান, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। কারা সেখানে ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে বিতর্কিত কর্মকান্ড করছে সেটাও আমি জানিনা। আর যদি কেউ ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কোনো অপকর্ম করে থাকে তার দায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নেবে না।
সুত্র: হ্যালো বরিশাল